সিয়াম অর্থ রোযা। এটা ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরজ বিধান। হাদীছ শরীফের ভাষ্যমতে জানা যায়, রোযা ইসলামের একটি রুকনও বটে। হাদীছ শরীফের যে পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের ভিত্তি নির্ভরশীল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তন্মধ্যে রোযা অন্যতম। ইরশাদ হয়েছে, بنى الإسلام على خمس شهادة ان لا اله الاالله وان محمدا رسول الله وإقام الصلوة وإيتاء الزكاة
সিয়াম অর্থ রোযা। এটা ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরজ বিধান। হাদীছ শরীফের ভাষ্যমতে জানা যায়, রোযা ইসলামের একটি রুকনও বটে। হাদীছ শরীফের যে পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের ভিত্তি নির্ভরশীল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তন্মধ্যে রোযা অন্যতম। ইরশাদ হয়েছে,
بنى الإسلام على خمس شهادة ان لا اله الاالله وان محمدا رسول الله وإقام الصلوة وإيتاء الزكاة والحج وصوم رمضان
‘পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের ভিত্তি নির্ভরশীল। (সেগুলো হচ্ছে) ১. এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা‘বূদ নাই। আর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ তা‘আলার রাসূল, ২.নামায কায়েম করা ৩. যাকাত আদায় করা ৪.হজ্জ আদায় করা ৫.রমজানের রোযা রাখা।’ (বুখারী শরীফ: হাদীস নং-৮)
রোযা সম্পর্কিত আলোচনা অত্যন্ত বিস্তৃত। তবে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে সেসব বিস্তারিত আলোচনার পরিবর্তে কেবলমাত্র রমজানের রোযা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে যে বর্ণনা রয়েছে, তা খুবই সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ উপস্থাপন করা হয়েছে। রোযা ফরজ হওয়া সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে,
ياَيُّهَاالَّذِيْنَ امَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ ۞ اَيَّامًا مَّعْدُوْدتٍ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَّرِيْضًا اَوْ عَلى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ اَيَّامٍ اُخَرَ وَعَلى الَّذِيْنَ يُطِيْقُوْنَه فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِيْنٍ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَّه وَاَنْ تَصُوْمُوْا خَيْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ۞
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। মাত্র কয়েক দিন (রোযা রাখ)। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হয় অথবা সফরে থাকে সে অন্য সময় গণনা করে রোযা রাখবে। আর যারা রোযা রাখতে সক্ষম (হওয়া সত্ত্বেও রোযা রাখা কষ্টকর হয়) তাদের কর্তব্য হচ্ছে একজন মিসকীনকে খাবার ফিদয়া দেওয়া। অতঃপর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কল্যাণ করে অর্থাৎ নির্ধারিত পরিমাণ হতে ফিদয়া বেশী প্রদান করে তবে (এটা) তার জন্য আরো উত্তম। আর তোমাদের রোযা রাখা খুবই উত্তম যদি তোমরা (রোযার ফজীলত সম্পর্কে) জ্ঞান রাখ।’
(সূরাহ্ বাকারাহ: ১৮৩-১৮৪)
ياَيُّهَاالَّذِيْنَ امَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ
এখানে উম্মতে মুহাম্মদীর উপর রোযা ফরজ হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার স্থান আরবের মরুবাসীদের জন্য প্রচন্ড গরম ও প্রখর রৌদ্র উপেক্ষা করে সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য একটি কাজ। তাই রোযার বিধান ফরজ ঘোষণার পরপরই এই বলে সান্ত¡না প্রদান করা হয়েছে যে, রোযার এই বিধান তোমাদেরকেই প্রথম দেওয়া হয়নি; বরং তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও রোযা ফরজ ছিল। তবে তাদের উপরও যে রমজানের রোযা ফরজ ছিল, এমন নয়; বরং একেক উম্মতের উপর ভিন্ন ভিন্ন সময়ের রোযা ফরজ করা হয়েছিল। জানা যায় যে, হযরত আদম আ. এর উপর প্রতিমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোযা ফরজ ছিল। তেমনিভাবে হযরত নূহ আ. এর উপর সারা বৎসরই রোযা রাখা ফরজ ছিল। এমনিভাবে অন্যান্য নবীগণের উপর ফরজকৃত রোযার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা ছিল।
لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ এতে রোযার হিকমাত বর্ণনা করা হয়েছে। রোযার হিকমাত হচ্ছে মানুষকে তাক্বওয়া অবলম্বনের শিক্ষা দেওয়া। কারণ, মানুষ যে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকে সেটা একমাত্র আল্লাহ্রই ভয়ে। কারণ, অন্ধকার কক্ষে কেউ যদি পানাহার কিংবা স্ত্রী সহবাস করে তাহলে সেখানে আল্লাহ ছাড়া কেউ তা দেখার থাকে না। অথচ এমতাবস্থায়ও কেউ এমন আচরণ করতে উদ্যত হয় না। সেখানে একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার ভয়ই তাকে এসব কাজ থেকে বিরত রাখে। এভাবে সুদীর্ঘ একটি মাস যখন কেউ কেবলমাত্র আল্লাহর ভয়ে এসব হালাল বিষয়াদি বর্জনের অনুশীলন করবে তখন আশা করা যায় যে, এর মাধ্যমে রমজান ছাড়া বৎসরের অন্যান্য সময়ে আল্লাহ্র ভয়ে সে হারাম জিনিসগুলো বর্জন করতেও সক্ষম হবে।
اَيَّامًا مَّعْدُوْدتٍ এখানে আবারো উম্মতে মুহাম্মদীকে সান্ত¦না দিয়ে বলা হয়েছে যে, এ ফরজ রোযার বিধান মাত্র কয়েক দিনের জন্য। তিনশত ষাট দিনের মধ্য হতে উনত্রিশ অথবা ত্রিশ দিন রোযা রাখা খুব বেশী কষ্টসাধ্য কাজ নয়।
فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَّرِيْضًا اَوْ عَلى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ اَيَّامٍ اُخَرَ এখানে অসুস্থ ও সফররত ব্যক্তির রোযার হুকুম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কেউ যদি রমজান মাসে এমন (মারাত্মক) অসুস্থ থাকে, যে কারণে তার দ্বারা রোযা রাখা সম্ভব হয় না অথবা (শরীয়তের দৃষ্টিতে) মুসাফির থাকে তাহলে অসুস্থতা বা সফরের কারণে রমজানের যে কয়েক দিনের রোযা রাখতে না পারে অন্য সময়ে সেগুলো ক্বাজা করবে।
وَعَلى الَّذِيْنَ يُطِيْقُوْنَه فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِيْنٍ এ অংশে রোযা ফরজ হওয়ার প্রাথমিক অবস্থার একটি বিধান সম্পর্কিত আলোচনা করা হয়েছে , যা বর্তমানে রহিত হয়ে গিয়েছে। আর সেই বিধানটি হচ্ছে,রোযা রাখতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও রোযার কষ্টভোগে অনভ্যস্থতার দরুণ রোযার পরিবর্তে মিসকীনকে খাবার ফিদয়া দেওয়ার অনুমতি। অর্থাৎ এক রোযার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে দু’বেলা খাবার প্রদান করা।
অবশ্য وَعَلى الَّذِيْنَ يُطِيْقُوْنَه فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِيْنٍ ط এর ব্যাখ্যায় বহু সংখ্যক মুফাস্সির ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁরা ব্যাকরণের ভিন্ন ভিন্ন দু’টি বিষয় উল্লেখ করে এ আয়াতাংশের তরজমা করেন ‘আর যারা রোযা রাখতে অক্ষম, তাদের কর্তব্য হচ্ছে একজন মিসকীনকে খাবার ফিদয়া দেওয়া।’ সুতরাং এর ব্যাখ্যায় তাঁরা বলেন, এ আয়াতাংশে চরম বার্ধক্যে উপনীত অথবা দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত (যাদের সুস্থ হয়ে রোযা কাজা করার আশা নেই এমন) ব্যক্তির রোযার হুকুম বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ এরূপ ব্যক্তিদের একেক রোযার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে দু’বেলা খাবার প্রদান করতে হবে।
فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَّه ط وَاَنْ تَصُوْمُوْا خَيْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ এখানে উপরোক্ত দু’টি হুকুম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সক্ষম ব্যক্তির রোযার ক্ষেত্রে যে ফিদয়ার কথা বলা হয়েছে সেই ফিদয়া নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অধিক প্রদান করা উত্তম বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এ আয়াতাংশে। তেমনিভাবে অসুস্থ ও মুসাফির ব্যক্তির জন্য রমজানের পরিবর্তে অন্য সময়ে যে রোযা রাখার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে, তা সত্ত্বে যদি কেউ এমতাবস্থায়ও রোযা রাখে তাহলে সেটা তার জন্য অধিক উত্তম।
সূরাহ্ বাকারার পরবর্তী ১৮৫ নং আয়াতে রমজান মাস, এ মাসের রোযা, অসুস্থ ও মুসাফিরদের জন্য অন্য সময়ে রোযা রাখার অনুমতি এবং এর দ্বারা আল্লাহ পাকের হিকমাত ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىْ اُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْانُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنتٍ مِنَ الْهُدى وَالْفُرْقَانِ ج فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ط وَمًَنْ كَانَ مَرِيْضًا اَوْ عَلى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ اَيَّامٍ اُخَر َ ط يُرِيْدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَيُرِيْدُ بِكُمُ الْعُسْرَ ز وَلِتُكْمِلُوْا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلى مَاهَديكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ
‘রমজান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন। (এই কুরআন) মানুষের জন্য হিদায়েত এবং দিক-নির্দেশনা ও (ন্যায়-অন্যায়ের) পার্থক্য করার স্পষ্ট প্রমাণ। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাসে বর্তমান থাকে তারা যেন রোযা রাখে। আর যে (রমজান মাসে) অসুস্থ অথবা মুসাফির থাকে,সে অন্য সময় গণনা করে রোযা রাখবে। আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের প্রতি সহজ করনের ইচ্ছা করেন এবং কঠোরতার ইচ্ছা করেন না। আর যেন তোমরা নির্দিষ্ট সংখ্যা পূর্ণ করতে পার এবং তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা যেন আল্লাহ তা‘আলার শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে পার। আর যেন তোমরা শুকরিয়া আদায় কর।’
(সূরাহ্ বাকারাহ্: ১৮৫)
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىْ اُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْانُ ইতিপূর্বে যে ঘোষণা করা হয়েছিল, ‘মাত্র কয়েক দিনের রোযা রাখ’ এ আয়াতাংশে সেটারই বিবরণ দেওয়া হচ্ছে যে, সেই অল্প কয়েকদিন দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে রমজান মাস, যা সর্বোচ্চ উনত্রিশ বা ত্রিশ দিনে হয়।
এরই সাথে রমজান মাসের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা বর্ণনা করত: বলা হয়েছে, এটা এমন মহিমান্বিত মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। উল্লেখ্য যে, পবিত্র কুরআন যদিও রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট ধারাবাহিকভাবে অবতীর্ণ হয়েছে এবং সুদীর্ঘ তেইশ বৎসরে এর অবতরণ কার্য সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু ধারাবাহিকভাবে কুরআন নাযিলের সূচনা হওয়ার পূর্বে লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ কুরআন একত্রে প্রথম আসমানের ‘বাইতুল ইজ্জাত’ এ নাযিল করা হয়। আর এ নুযূলকার্য সম্পন্ন হয় রমজান মাসের কদরের রাতে। এখানে রমজান মাসে কুরআন নাযিল হওয়ার বর্ণনা দ্বারা সে বিষয়টিই বুঝানো হয়েছে।
فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ط وَمًَنْ كَانَ مَرِيْضًا اَوْ عَلى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ اَيَّامٍ اُخَرَ
এখানে রমজানের রোযার অপরিহার্যতার বিষয়টি বিশেষভাবে বর্ণনা করে (রমজানের রোযা ফরজ থাকা সত্ত্বেও) ইতিপূর্বে সামর্থবানদের জন্য রোযা না রেখে ফিদয়া দেওয়ার যে বিধান ছিল, তা রহিত করা হয়েছে। তবে অসুস্থ ও মুসাফিরদের জন্য পূর্ববর্তী হুকুমের কোন রদবদল হয়নি; বরং তা পূর্বাবস্থায় বহাল রয়েছে। আর সেজন্যই পূর্বোক্ত হুকুমের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে।
يُرِيْدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَيُرِيْدُ بِكُمُ الْعُسْرَ ز অসুস্থ ও মুসাফির ব্যক্তির রোযার বিধান শিথিল করার পর বান্দাহ্র প্রতি বিধান আরোপ করার ক্ষেত্রে আল্লাহ পাকের সুন্নাত ও তরীকার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তিনি বিধান আরোপের ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় বান্দাহ্র সাথে সহজ আচরণ করতে চান। সেই ধারাবাহিকতায় অসুস্থ ও মুসাফির ব্যক্তির রোযার বিধান সহজ করা হয়েছে।
وَلِتُكْمِلُوْا الْعِدَّةَ রোযা যথাসময়ে আদায় করা এবং ওজরের কারণে পরবর্তিতে কাজা করা সংক্রান্ত বিধানের হিকমাত বর্ণনা করা হয়েছে এ আয়াতাংশে। বলা হয়েছে , যেন তোমরা এর মাধ্যমে রোযার নির্ধারিত সংখ্যা পূর্ণ করতে পার। ফলে পূর্ণ ছাওয়াব লাভ করতে পার।
وَلِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلى مَاهَديكُمْ বিশেষভাবে রোযা কাজা করার বিধান দেওয়ার হিকমাত বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, এ বিধান এ জন্য দেওয়া হয়েছে যাতে তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়েত (রোযা কাজা করা) এর উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা কর। অন্যথায় কোনভাবেই রোযার পুরোপুরি ছাওয়াব ও বারাকাত লাভ করা সম্ভব হত না। কেননা, ওজর থাকার কারণে রোযা রাখা সম্ভব হত না। এমতাবস্থায় অন্য সময় কাজা করার অনুমতি না থাকলে মানুষ রোযার ছাওয়াব হতে নিশ্চিত মাহরূম হয়ে যেত।
وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ ওজরবশত: রমজানে রোযা না রাখার অনুমতি প্রদানের হিকমাত বর্ণনা করত: বলা হয়েছে, যাতে তোমরা রমজানে রোযা না রাখার অবকাশ দেওয়ার ন্যায় নিয়ামতের প্রতি আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করতে পার। অন্যথায় এ সুযোগ না থাকলে কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হত।
এরপর ১৮৬ নং আয়াতে অবশ্য রোযা সম্পর্কিত সরাসরি আলোচনা স্থান পায়নি। তবে পূর্বোক্ত আয়াতে রোযা বিষয়ক আলোচনায় প্রসঙ্গ ক্রমে বান্দাহ্র প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ ও দয়ার বর্ণনা রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় এ আয়াতেও আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহের বর্ণনা রয়েছে। আর তা হচ্ছে আল্লাহ পাকের বান্দাহ্র নিকটবর্তী হওয়া ও দু‘আ কবুলের ঘোষণা। এছাড়া পূর্বোক্ত আয়াতে রমজান মাসের আলোচনা রয়েছে, যে মাসে অন্যান্য সময়ের তুলনায় দু‘আ অধিক কবুল হয়। আর পরবর্তী আয়াতেও দু‘আ কবুল সংক্রান্ত আলোচনা স্থান পেয়েছে। সুতরাং দ্বিতীয় আয়াতে রমজান বিষয়ক আলোচনা না থাকলেও উভয় আয়াতের বিষয় বস্তুর মাঝে চমৎকারিত্বপূর্ণ সামঞ্জস্য বিদ্যমান রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
وَاِذَا سَاَلَكَ عِبَادِىْ عَنِّىْ فَاِنِّىْ قَرِيْبٌ اُجِيْبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ اِذّا دَعّانِ فَلْيَسْتَجِيْبُوْا لِىْ وَلْيُؤْمِنُوْا بِىْ لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُوْنَ ۞
‘আমার বান্দাগণ আমার ব্যাপারে যখন তোমাকে প্রশ্ন করে (তখন তুমি তাদেরকে বল) যে আমি তো নিকটেই। আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে তখন আমি তার আহ্বানে সাড়া দেই। সুতরাং তারা আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।’ (সূরাহ্ বাকারাহ্: ১৮৬)
রমজান বিষয়ক আলোচনার পর এ আয়াতে দু‘আর আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দ্বারা এ কথা বুঝা যায় যে, রমজান মাসে অধিক পরিমাণে আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করা আমাদের কর্তব্য।
পরবর্তী ১৮৭ আয়াতে রমজানের রাতে পানাহার ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি, সাহরীর শেষ সময় নির্ধারণ ও ই‘তিকাফের বিধান আলোচনা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে,
اُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ اِلى نِسَائِكُمْ ط هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَاَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ ط عَلِمَ اللهُ اَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَخْتَانُوْنَ اَنْفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَاعَنْكُمْ ج فَالْئنَ بَاشِرُوْهُنَّ وَابْتَغُوْا مَا كَتَبَ اللهُ لَكُمْ ص وَكُلُوْا وَاشْرَبُوْا حَتّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْاَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْاَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ص ثُمَّ اَتِمُّوْا الصِّيَامَ اِلَى اللَّيْلِ
‘তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে রোযার রাতে স্ত্রী সহবাস করা। তারা তোমাদের আবরণ এবং তোমরা তাদের আবরণ স্বরূপ। আল্লাহ তা‘আলা জানতেন যে, তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হয়েছেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করেছেন। সুতরাং এখন তোমরা তাদের সাথে মেলামিশা কর এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন তা কামনা কর। আর তোমরা পানাহার কর রাতের কাল রেখা হতে সুবহে সাদিকের সাদা রেখা পৃথকরূপে প্রতিভাত না হওয়া পর্যন্ত। অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত।’
اُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ اِلى نِسَائِكُمْ….. ثُمَّ اَتِمُّوْا الصِّيَامَ اِلَى اللَّيْلِ রোযা ফরজ হওয়ার পর প্রাথমিক পর্যায়ে রমজানের রাতগুলোতে কেবলমাত্র ঘুমানোর পূর্ব পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি ছিল। কিন্তু এতে সাহাবায়ে কিরাম রা. কষ্টের সম্মুখীন হলে উক্ত বিধান রহিত করে সুবহে সাদিক পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি প্রদান করা হয়। সংশ্লিষ্ট আয়াতের প্রথমাংশে এ হুকুমটিই বর্ণিত হয়েছে। হযরত বারা ইবনে আ-যিব রা. বর্ণনা করেন যে, রমজানের রোযা ফরজ হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে ইফতারের পর হতে কেবলমাত্র ঘুমানোর পূর্ব পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি ছিল। সাহাবায়ে কিরামের রা. মধ্য হতে কেউ কেউ এতে দারুণ সমস্যার সম্মুখীন হতে লাগলেন। একদিনের ঘটনা হযরত কায়েস রা. সারাদিন মজদূরী করে সন্ধায় যখন বাড়ী ফিরলেন তখন ঘরে খাবারের তেমন কিছু ছিল না। তাঁর স্ত্রী খাবারের ব্যবস্থা করতে বাইরে গেলেন। এদিকে সারাদিনের ক্লান্তির কারণে হযরত কায়স রা. ঘুমিয়ে পড়লেন। পরে খাবার এলেও তা গ্রহণ করতে পারলেন না। কারণ নিদ্রা যাপনের পর সে সময় খাবারের বিধান ছিল না। তাই আর কোন কিছু না খেয়ে পরদিন রোযা রাখলেন। এদিকে দুপুরের প্রচন্ড গরমে তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। অনুরূপভাবে বিভিন্ন সাহাবী রা. রাতে স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হয়ে দারুণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে পূর্বের হুকুম রহিত করে সূর্যাস্ত হতে সুবহে সাদিক পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি দেওয়া হয়। এছাড়াও উক্ত আয়াতাংশে সাহ্রীর শেষ সময়সীমা অর্থাৎ রোযা কখন থেকে শুরু হয়ে কখন শেষ হবে এর বর্ণনাও রয়েছে।
وَلاَتُبَاشِرُوْهُنَّ وَاَنْتُمْ عكِفُوْنَ لا فِىْ الْمَسجِدِ
‘আর মসজিদে ই‘তিকাফরত অবস্থায় তোমরা তাদের সাথে মেলামিশা করো না।’
এখানে রোযার আলোচনার সাথে প্রসঙ্গক্রমে ই‘তিকাফের একটি বিশেষ হুকুম ও আলোচনা করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে, রোযার রাতে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস বৈধ থাকলেও ই‘তিকাফকারীর জন্য স্ত্রী সহবাস বৈধ নয়। কেননা, তারা তখন মসজিদে অবস্থান করে।
تِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ فَلاَ تَقْرَبُوْهَا كَذلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ ايتِه لِلنَّاسِ لّعَلَّهُمْ يَتَّقُوْنَ
‘এগুলো আল্লাহ্র সীমারেখা। এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নির্দেশাবলী মানবজাতির জন্য সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।’
উপরোক্ত বিধানসমূহকে আল্লাহ তা‘আলার সীমারেখা আখ্যায়িত করে এগুলোর নিকটবর্তী হওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
মাহে রমজানের রোযা সম্পর্কে কুরআনে কতটুকু আলোচনা রয়েছে, যেহেতু কেবলমাত্র সেটা বর্ণনা করাই এখানে উদ্দেশ্য, তাই রোযা সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় এখানে আলোচিত হয়নি। আর কলেবর বৃদ্ধির আশংঙ্কায় আয়াতের তেমন কোন তাফসীরও উল্লেখ করা হয়নি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে মাহে রমজানের রোযাগুলো হক আদায় করে রাখার তাওফীক দান করুন। আমীন ॥
মতামত দিন
আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।