ইলমে তাফসীরের সূচনা ও ক্রম বিকাশ পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আরবী ভাষায়। কুরআন অবতারন ভূমির অধিবাসীদের মাতৃভাষা ছিল আরবী, বিধায় কালামে পাকের অর্থ ও উদ্দেশ্য বুঝতে তাদের তেমন কষ্ট হতনা। তবুও যেসব আয়াতের ভাবার্থ কঠিন মনে হত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট জিজ্ঞাসা করে তারা সেগুলোর সঠিক সমাধান লাভ করতেন। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ইলমে তাফসীরের সূচনা ও ক্রম বিকাশ
পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আরবী ভাষায়। কুরআন অবতারন ভূমির অধিবাসীদের মাতৃভাষা ছিল আরবী, বিধায় কালামে পাকের অর্থ ও উদ্দেশ্য বুঝতে তাদের তেমন কষ্ট হতনা। তবুও যেসব আয়াতের ভাবার্থ কঠিন মনে হত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট জিজ্ঞাসা করে তারা সেগুলোর সঠিক সমাধান লাভ করতেন। কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন সুমহান মর্যাদা দানের পাশাপাশি কুরআন কারীমের মুফাসসির ও মুখপাত্র হওয়ার অনন্য গৌরব দান করেছেন। পৃথিবী বুকে তিনিই হচ্ছেন কুরআনে কারীমের প্রথম মুফাসসির। ইরশাদ হচ্ছে:
وانزلنا اليك الذكر لتبين للناس مانزل اليهم
আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে মানুষের নিকট স্পষ্ট করে বর্ণনা কর তাদের প্রতি কী অবতীর্ণ করা হয়েছে। (সূরাহ্ নাহল) ইলমে তাফসীরের সূচনা যদিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগ থেকেই হয়েছে, কিন্তু এর ক্রমবিকাশ বা উন্নতি অগ্রগতি পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন যুগে হয়েছে এবং এটা একটি শাস্ত্রের রূপ লাভ করেছে।
সাহাবী যুগে ইলমে তাফসীর
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর যখন ইসলামী রাষ্ট্রের পরিধি বি¯িতৃত হতে লাগল এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতির মানুষ ইসলামের ছায়াতলে ব্যাপকভাবে আশ্রয় নিতে শুরু করলো তখন নতুন নতুন সমস্যার শরয়ী সমাধানও অপরিহার্য হয়ে গেল এই প্রেক্ষিতেই কুরআনে কারীমের আহকাম সম্বলিত আয়াত নিয়ে গবেষণা শুরু হল। আল্লামা ইবনে খালদুন রহ. বর্ণনা করেন: কুরআনে কারীমের মর্ম অনুধাবনে সকল সাহাবী সমপর্যায়ের ছিলেন না আর তাদের তাফসীর পদ্ধতীও ছিল ভিন্ন ভিন্ন । সাহাবায়ে কিরামের মাঝে ষোল জন তাফসীর শাস্ত্রে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। সাহাবায়ে কিরাম রা. কুরআনে কারীমের যথার্থ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে কঠোর সাধনা ও অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। কুরআন চর্চার প্রতি মানুষের মনে আগ্রহ সৃষ্টিতেও তাদের ত্যাগ ছিল তুলনহীন। ফলে মানুষ কুরআন চর্চার প্রতি উৎসাহী হয়ে দলে দলে তাদের নিকট এসে সমবেত হত।
সাহাবী যুগে তাফসীরুল কুরআনের উৎস
সাহাবায়ে কিরাম পবিত্র কুরআনের তাফসীর করার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ করতেন।
১.কুরআনে কারীম, অর্থাৎ কুরআনে কারীমের কোন আয়াতের ব্যাখ্যা বুঝে না আসলে কুরআনে উল্লিখিত অনুরূপ অন্য আয়াতে এর ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করতেন। কেননা, কুরআনের কোন স্থানে একটি বিষয় সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, আবার অন্যত্র সেই বিষয়টিই বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
২.হাদীসে রাসূল, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থাৎ সরাসরি অথবা কারো মাধ্যমে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে কুরআনে কারীমের যেসব আয়াত সম্পর্কে অবগত হয়েছেন।
৩.ইজতিহাদ, অর্থাৎ কোন আয়াতের ব্যাখ্যা – বিশ্লেষণে কুরআন ও হাদীসে সমাধান না পেলে তারা নিজেদের চিন্তা শক্তি ব্যায় করে ইজতিহাদ করতেন।
৪.আহলে কিতাব, অর্থাৎ কুরআনে পুর্ববর্তী উম্মতদের ঘটনার বিবরণ খুবই সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। অন্যদিকে তাওরাত, ইঞ্জিলে এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। ফলে সাহাবায়ে কিরাম ঘটনা সম্বলিত কোন আয়াতের বিশ্লেষণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীসে না পেলে আহলেকিতাবের মধ্য হতে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাদের শরণাপন্ন হতেন।
সাহাবী যুগের তাফসীরী বৈশিষ্ট্য
*এসময় পূর্ণ কুরআনের তাফসীরের পরিবর্তে কেবল যেসব আয়াতের ব্যাখ্যা অনুধাবনে জটিলতা হত সেগুলোরই তাফসীর করা হত।
*কুরআনে কারীমের অর্থ বুঝতে তাদের মাঝে তেমন কোন মত বিরোধ হতনা।
*কুরআনের অধিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের চেয়ে কেবল সংক্ষিপ্ত অর্থ জানাকে যথেষ্ট মনে করা হত।
*কুরআনী আয়াত হতে ফিক্বহী মাসায়িল বের করার চর্চাও তেমন ছিলনা।
*তখন পর্যন্ত সংকলিত কোন তাফসীর গ্রন্থ ছিলনা। অবশ্য কোন কোন সাহাবী নিজ নিজ কুরআনের কপিতে বিশ্লেষণমূলক শব্দ লিখে রাখতেন।
*হাদীস বর্ণনার ন্যায় বর্ণনাকারীদের ধারা উল্লেখপূর্বক তাফসীর বর্ণনা করা হত।
তাবেয়ী যুগে ইলমে তাফসীর
সাহাবী যুগ পরিসমাপ্তি ঘটার সাথে সাথেই তাফসীরূল কুরআন এর ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হয়। তাবিয়ীগণ সাহাবায়ে কিরামের ইলমি ঝরণা হতে জ্ঞানের তৃষ্ণা নিবারণ করেন এবং কুরআনের তাফসীর অনুধাবনে গভীর সাধনা অব্যাহত রাখেন। ফলে তাবিয়ীগণের মাঝেও জগদ্বিখ্যাত মুফাস্সিরে কুরআন সৃষ্টি হয়।
ধারণা করা হয় শাস্ত্র আকারে এর সূচনা করেছিলেন হযরত সাঈদ ইবনে জুবাইর রহ. খলীফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের অনুরোধক্রমে তিনি একটি তাফসীর গ্রন্থ রচনা করে দরবারে খিলাফাতে পেশ করেন। আতা ইবনে দ্বীনার এর নামে যে তাফসীর গ্রন্থটি প্রসিদ্ধি লাভা করেছে সেটি মূলত এই তাফসীর গ্রন্থই। সাহাবায়ে কিরামের যুগে যেসব তাফসীরুল কুরআনের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল, তাবেয়ী যুগে সেগুলোর আরো উন্নতি অগ্রগতি সাধিত হয়। বহুসংখ্যক লোক সেগুলোতে অংশগ্রহণ করে কুরআনী জ্ঞানের তৃষ্ণা নিবারণ করতেথাকে। সেই সাথে মুফাসসিরে কুরআন তাবিয়ীগনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আরো বিভিন্ন স্থানে তাফসীরুল কুরআনের মাদরাসা গড়ে উঠে এবং সেগুলোতেও একইরূপে ব্যাপকভাবে কুরআনের দরস অব্যাহদ থাকে।
তাবিয়ী যুগে তাফসীরুল কুরআনের উৎস
কুরআনের তাফসীর করতে তাবিয়ীগণ যে বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করতেন সেগুলো হচ্ছে নিম্নরূপ:
১. কিতাবুল্লাহ।
২. হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
৩. সাহাবায়ে কিরাম রা. এর নিজস্ব তাফসীরী বর্ণনা।
৪. আহলে কিতাব হতে প্রাপ্ত সাহাবায়ে কিরামের তাফসীরী বর্ণনা।
৫. তাবিয়ীগণের নিজেদের ইজতিহাদ।
তাবিয়ী যুগের তাফসীরী বৈশিষ্ট্য
* এসময় ইয়াহুদী-নাসারাদের অধিকহারে ইসলাম গ্রহণের ফলে তাফসীর শাস্ত্রে তাদের বিভিন্ন কল্পকাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটে।
* তাফসীর সংরক্ষণ, গ্রহণ ও বর্ণনাসহ সবই হত মৌখিক বর্ণনার মাধ্যমে। সংকলন পদ্ধতি তখনো ছিলনা।
* এ যুগে বিভিন্ন মত ও পথের উদ্ভব ঘটে। সুতরাং বিভিন্ন মতাদর্শের লোকদের তাফসীরের ক্ষেত্রে তাদের মতাদর্শ প্রভাব বিস্তার করে।
* তাফসীরুল কুরআনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম মতবিরোধ সৃষ্টি হয়।
ইলমে তাফসীরের সংকলন যুগ
উমাইয়া শাসনামলের শেষভাগ হতে তাফসীর সংকলনের সূচনা হয়, যা খিলাফাতে আব্বাসিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময়েই প্রকৃত অর্থে তাফসীরুল কুরআন সংকলনের সূচনা হয়। এর পূর্ব পর্যন্ত তাফসীর সংক্রান্ত রিওয়ায়াত হাদীসে নববীর সাথে মিশ্রিত ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত ছিল। আর সেসবের মধ্য হতে একটি অধ্যায়ে তাফসীর সংক্তান্ত বর্ণনাগুলো সন্নিবেশিত থাকত। এ যুগে হাদীস গ্রন্থগুলো হতে তাফসীরী বর্ণনাসমূহ পৃথক করে একটি স্বতন্ত শাস্ত্রের রূপ দেয়া হল। এ সুমহান কাজে ইবনে মাজাহ, ইবনে জারীর ত্ববারী, ইবনে আবী হাতেম, ইমাম হাকীম প্রমুখ অংশ গ্রহণ করেন। এ সব তাফসীরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিয়ীগণের বর্ণনাসহ লিপিবদ্ধ ছিল। অবশ্য ইবনে জারীর ত্ববারী তাফসীরী বর্ণনা করত:সেগুলোর বিশ্লেষণ করেছেন এবং একটিকে অপরটির উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। এরূপ মতবিরোধ সত্তেও এ যুগের তাফসীর কেবল রিওয়ায়াতের আলোকে কুরআনের তাফসীর করার মধ্যেই সীমিত ছিল। তবে এগুলোর জন্য সনদের শর্ত ছিলনা বিধায় অনেক মনগড়া বিষয়ও তাফসীর শাস্ত্রের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। ফলে সঠিক বর্ণনা ও ত্রুটিপূর্ণ বর্ণনার মাঝে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ল।
তাফসীর শাস্ত্রের সংকলন পরবর্তী যুগ
এ সময়কাল হতেই তাফসীর শাস্ত্রের পরবর্তী যুগের সূচনা হয় এটাই তাফসীর শাস্ত্রের দীর্ঘতম ঐতিহাসিক যুগ। খিলাফাতে আব্বাসিয়ার সময়কাল হতে আরম্ভ হয়ে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময় হতে তাফসীর বিলমা‘ছূর ও তাফসীর বিগাইরিলমা‘ছূরের সূচনা হয়। সরফ,নাহব সহ আরবী ভাষা কেন্দ্রিক বিভিন্ন শাস্ত্র সংকলিত হয়। ফিক্বহী মাসায়িলকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিভিন্ন মাযহাব প্রকাশ্য রূপ লাভ করে। আক্বীদাগত মাসায়িল নিয়ে তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত হয়। গোত্রীয় দ্বন্দ চরমে পৌঁছে। তর্ক শাস্ত্র ও দর্শন শাস্ত্রের কিতাব সমূহ গ্রীক ভাষা হতে আরবী ভাষায় রূপান্তরিত হয় পরিণতিতে তাফসীর শাস্ত্রে এসব বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটে। সুতরাং যে ব্যক্তি যে বিষয়ে অধিক পারদর্শী ছিল তার কৃত তাফসীর গ্রন্থ সে বিষয়ের আলোচনার মাঝেই যেন সীমিত হয়ে পড়ত। এ সময়ে তাফসীরুল কুরআন ছাড়াও কুরআনের বিশেষ বিশেষ বিষয়কে কেন্দ্র করে স্বতন্ত গ্রন্থ সংকলনের সূচনা হয়। কেউ কেবলমাত্র ফিক্বহী মাসায়িল প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। কেউ আসবাবুন নুযুল একত্রিত করেছেন।কেউ কেবল কুরআনে ব্যবহ্নত অনারবী ভাষার শব্দগুলো একত্রিত করেছেন। এভাবে বিভিন্ন জন বিভিন্ন বিষয়কে একত্রিত করেছেন। এরূপ বিষয়ের সংখ্যা প্রায় আশি পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপর স্বতন্ত্র কিতাব রচিত হয়েছে বলে আল্লামা সূয়ূতী রহ. তৎপ্রণীত গ্রন্থ আলইতক্বানে উল্লেখ করেছেন।
তাফসীরুল কুরআনের এ যুগের সূচনা পর্ব পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়
তাফসীরুল কুরআন ও উলূমুল কুরআনের উপর যে কত হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত হয়েছে, তা নির্ধারণ করা দুঃসাধ্য।
এ প্রয়াস এখনো অব্যাহত রয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকবে কিয়ামাত পর্যন্ত।
মতামত দিন
আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।