উর্দূ ভাষায় সংকলিত তরজমাতুল কুরআন ও তাফসীর গ্রন্থঃ পরিচিতি ও পর্যালোচনাঃ পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে আরবী ভাষায়। তাই সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের ভাষায় অবতীর্ণ আল-কুরআনের অনেক আয়াতের অর্থ ও মর্ম অতি সহজেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। কোন আয়াতের মর্ম উদঘাটনে সমস্যার সম্মুখীন হলে রাসূলে আকরাম সা. এর নিকট জিজ্ঞাসা করে এর সমাধান করিয়ে নিয়েছেন। এভাবেই তাঁদের
উর্দূ ভাষায় সংকলিত তরজমাতুল কুরআন ও তাফসীর গ্রন্থঃ
পরিচিতি ও পর্যালোচনাঃ
পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে আরবী ভাষায়। তাই সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের ভাষায় অবতীর্ণ আল-কুরআনের অনেক আয়াতের অর্থ ও মর্ম অতি সহজেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। কোন আয়াতের মর্ম উদঘাটনে সমস্যার সম্মুখীন হলে রাসূলে আকরাম সা. এর নিকট জিজ্ঞাসা করে এর সমাধান করিয়ে নিয়েছেন। এভাবেই তাঁদের মাঝে আল-কুরআনের চর্চা অব্যাহত থাকে। কিন্তু ইসলাম যখন আরব ভূখন্ড পেরিয়ে অনারবদের মাঝে প্রচারিত হতে শুরু করল এবং কুরআনের ভবিষ্যদ্বানী:وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا
“আর আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন।” (সূরা নাসর:২) অনুযায়ী মানুষ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে লাগল, তখন তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষায় আল-কুআনের অনুবাদ করার প্রয়োজন দেখা দিল। সুতরাং এ প্রেক্ষিতে সাহাবায়ে কিরামের যুগ থেকেই অনারবী ভাষায় কুরআন কারীমের তরজমা বা অনুবাদ কার্যক্রম শুরু হয়ে গিয়েছিল।
শামসূল আয়িম্মা সারাখসী র. ‘আলমাবসূত’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, হযরত সালমান ফারসী রা. আরবী না জানা পারস্যের অধিবাসীদের জন্য. ফার্সী ভাষায় সূরা ফাতিহার তরজমা করেছিলেন। (আল-মাবসূত:খ-১,পৃ-৩৭)
হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রসিদ্ধ পর্যটক বায্রুক ইবনে শাহরিয়ার, তার ছফরনামা ‘আজায়িবুল হিন্দ’ এ কুরআন মাজিদের একটি তরজমার উল্লেখ করেছেন যে, কাশ্মিরের রাজা মেহরুকের ইশারায় হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর শেষভাগে হিন্দুস্তানী ভাষায় কুরআনের অনুবাদ করা হয়েছে।
বাযরুক ইবনে শাহরিয়ার লিখেন যে, কাশ্মিরের রাজা মেহরুক ২৭০ হিজরী মুতাবিক ৮৮৩ ইংরেজীতে মানসূরার শাসক আমীর আব্দুল্লাহ বিন উমর এর নিকট লিখে পাঠিয়েছেন যে, আমার নিকট এমন কাউকে প্রেরণ করুন যিনি ইসলামী শরীয়াতের বিধি-বিধান হিন্দী ভাষায় বর্ণনা করতে পারেন। আমীর আব্দুল্লাহ হিন্দুস্তানের বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী এক আলেমকে সেখানে প্রেরণ করলেন। তিনি রাজা মেহরূকের নিকট কয়েক বৎসর অবস্থান করে ইসলামের যাবতীয় বিষয়াদি সস্পর্কে তাকে অবহিত করলেন। এরপর রাজা সেই আলিমের নিকট নিজের জন্য হিন্দী ভাষায় কুরআন কারীমের তরজমা ও তাফসীর লিখে দেয়ার অনুরোধ করলেন । রাজার অনুরোধের প্রেক্ষিতে তিনি আল-কুরআনের তরজমা ও তাফসীর লেখা শুরু করেন এবং তখন সূরা ইয়াসীন পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছিল বলে জানা যায়।
মোটকথা, সাহাবায়ে কিরামের যুগে শুরু হওয়া ভিন্ন ভাষায় কুরআন তরজমার কাজ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। ফলে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ভাষায়ই আল-কুরআনের তরজমা ও তাফসীর গ্রন্থ সংকলন সম্পন্ন হয়। তবে এটা সত্য যে, শুরুর দিকে অন্য যে কোন ভাষার তুলনায় ফার্সী ভাষায়ই কুরআনের তরজমা ও তাফসীর অধিক সংকলিত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, এক কালে হিন্দুস্তানের ভাষাও ছিল ফার্সী। সুতরাং এখানের উলামায়ে কিরামও ফার্সী ভাষায় কুরআনী খিদমাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নিজাম নীসাপুরী হিসাবে প্রসিদ্ধ হাসান বিন মুহাম্মদ আলকামী (৭৩০হিজরী) কৃত তরজমাটি হিন্দুস্তানে ফার্সী ভাষার প্রথম তরজমা বলে ধারণা করা হয়। তবে এ তরজমাটি সাধারণের মাঝে তেমন সমাদৃত না হওয়ায় আল্লামা শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছে দেহলভী র. ‘ফাতহুর রহমান’ নামে নতুন আঙ্গিকে পবিত্র কুরআনের তরজমা ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর সংকলন করেন। হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ র. কৃত এ তাফসীর গ্রন্থটি এখনো এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
এরপর হিন্দুস্তানের অধিবাসীদের ভাষায় ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে। মুসলমানগণ ফার্সী ভাষার পরিবর্তে উর্দূ ভাষাকে গ্রহণ করে। এর প্রচলন শুরু হয়। উর্দূ ভাষায় পবিত্র কুরআনের তরজমা ও তাফসীর সংকলনের প্রয়োজন হয়। যুগের উলামায়ে কিরাম এগিয়ে আসেন এবং সেই প্রয়োজন পূরণে যথাযথ ভূমিকা রাখেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উর্দূ ভাষায় প্রথম কুরআন তরজমার কৃতিত্বও হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহর আদর্শ সন্তানগণই অর্জন করেছেন।
উর্দূ ভাষায় পবিত্র কুরআনের তরজমা ও তাফসীর সংকলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দ্বাদশ হিজরী শতাব্দীর সত্তরের দশকে অর্থাৎ খৃষ্টীয় উনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকে উর্দূ ভাষায় কুরআন তরজমার প্রয়াস শুরু হয় এবং তা অব্যাহত থাকার ফলে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগেই পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আংশিক তরজমা সম্পন্ন হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। উর্দূ ভাষায় পবিত্র কুরআন তরজমার ইতিহাসে সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয় শাহ মুরাদুল্লাহ্ আনসারীর নাম। তিনিই সর্বপ্রথম উর্দূ ভাষায় কুরআন তরজমায় কলম ধরেন এবং ১১৮৪ হিজরী মুতাবেক ১৭৭০ খৃস্টাব্দে ত্রিশতম পারার তরজমা ও তাফসীর লেখা সম্পন্ন করেন। ( শাহ মুরাদুল্লাহ্ আনসারী কর্তৃক সংকলিত এ গ্রন্থটি তাফসীরে মুরাদিয়া নামে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলা থেকে ১২৪৭ হিজরী মুতাবিক ১৮৩১ খৃস্টাব্দে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। কিন্তু বাংলার তৎকালীন শাসকবর্গ এ গ্রন্থটিকে ওয়াহাবী সাহিত্য মনে করে এর মুদ্রণের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং প্রকাশিত সকল কপি বাজেয়াপ্ত করে। এরপর সরকারী নিষেধাজ্ঞা দূরীভূত হলে ১৮৪৪ খৃস্টাব্দে তা দ্বিতীয়বার প্রকাশিত হয়। পরে কলিকাতার সাত্তারিয়া প্রেস হতে ১৮৮০ খৃস্টাব্দে এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে পর্যায়ক্রমে তাফসীরে মুরাদিয়া মুদ্রিত হতে থাকে।
শাহ মুরাদুল্লাহ আনসারী র. স্বীয় তরজমা ও তাফসীর সম্পর্কে লিখেন যে, আল্লাহ তা‘আলার দয়া ও অনুগ্রহে ত্রিশতম পারার তাফসীর হিন্দী (উর্দূ) ভাষায় সম্পন্ন করিয়েছেন। এ তাফসীর ১১৮৪ হিজরীর মুর্হারম মাসের ২৪ তারিখ জুমুআর দিন শেষ হয়েছে।
তাফসীরে মুরাদিয়া হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছে দেহলভী রহ.এর ফাতহুর রহমান মুদ্রণের ছাব্বিশ বছর পর এবং হযরত শাহ আব্দুল কাদির র. এর মুযিহুল কুরআন লেখার একুশ বছর পূর্বে সংকলিত হয়েছিল বলে জানা যায়। (জায়িযায়ে তারাজিমে কুরআনী) তবে শাইখুত তাফসীর হযরত মাওলানা ইদ্রীস কান্ধলবী রহ. তাফসীরে মা‘আরিফুল কুরআন এর ভুমিকায় উল্লেখ করেছেন যে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী রহ. এর ৫৫ পঞ্চান্ন বছর পর ১২০৫ হিজরীতে শাহ আব্দুল কাদির রহ. উর্দূ ভাষায় তরজমা রচনা করেন। (মা‘আরিফুল কুরআন এর ভুমিকা:পৃ-১৪)
উর্দূ ভাষায় সংকলিত প্রথম তাফসীর গ্রন্থ:
উর্দূ ভাষায় সর্বপ্রথম সমগ্র কুরআন তরজমা করার অনন্য গৌরব অর্জন করেন হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছে দেহলভী র. এর সুযোগ্য সন্তান হযরত শাহ আব্দুল কাদির রহ.। তিনি উর্দূ ভাষায় সর্বপ্রথম কুরআন কারীমের ভাবানুবাদ করেন। এরপর শাহ আব্দুল কাদির র. এর বড় ভাই শাহ রফীউদ্দীন র. কুরআন কারীমের শব্দে শব্দে অনুবাদ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। হযরত শাহ আব্দুল কাদির রহ. কুরআন কারীমের তরজমার ভূমিকায় লেখেন যে, আমার মনে এল যেভাবে আমাদের সম্মানিত পিতা হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ র. ফার্সী ভাষায় সহজ করে কুরআন কারীমের অনুবাদ লিখেছেন। তেমনিভাবে আমিও উর্দূ ভাষায় কুরআন কারীমের তরজমা সহজ করে লিখব। আল্হামদুলিল্লাহ আমার এ আশা ১২০৫ হিজরী মুতাবিক ১৭৯০ খৃস্টাব্দে পূর্ণ হয়েছে। উক্ত দু’টি তরজমার মধ্যে প্রথম কোনটি সম্পাদিত হয়েছে, এ বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
উর্দূ ভাষার কোন ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, শাহ রফীউদ্দীন রহ. এর কুরআন কারীমের শব্দে শব্দে তরজমাই হচ্ছে উর্দূ ভাষার প্রথম কুরআন তরজমা।
এরূপ ধারণার সূত্রপাত সম্ভবত এভাবে হয়েছে যে, যেহেতু শাহ রফীউদ্দীন রহ. বয়সে শাহ আব্দুল কাদির র. এর চেয়ে বড় ছিলেন এজন্য কুরআন কারীমের তরজমাও হয়ত তিনি আগে সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু এ ধারণার স্বপক্ষে সমসাময়িক কোন উৎস থেকে এর উদ্ধৃতি পাওয়া যায় না। এছাড়া যদি শাহ রফীউদ্দীন রহ. এর তরজমা আগে সম্পন্ন হত তাহলে মূযিহুল কুরআন এর মুকাদ্দিমায় শাহ আব্দুল কাদির রহ. যেখানে স্বীয় পিতার ফার্সী তরজমার কথা উল্লেখ করেছেন সেখানে বড় ভাই শাহ রফীউদ্দীন রহ. এর তরজমার কথাও অবশ্যই উল্লেখ করতেন।
উর্দূ ভাষার উক্ত দুই তরজমা পরবর্তীতে কুরআন অনুবাদকদের জন্য অনুসরণীয় হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হল ইলমী ভাষাসমূহের মাঝে উর্দূ ভাষা নবীন হওয়া সত্ত্বেও এ ভাষায় যতটুকু পরিমাণ কুরআন মাজীদের অনুবাদ হয়েছে অন্য কোন ভাষায় তা হয়নি।
উল্লেখ্য যে, উক্ত দু’টি তরজমার পর পর্যায়ক্রমে উর্দূ ভাষায় পবিত্র কুরআনের আরো তরজমা সম্পন্ন হতে থাকে।
বাদশাহ শাহ আলম এর শাসনামলে (১১৭৩ হিজরী মুতাবিক ১৭৫৯ খৃস্টাব্দ ১২২১ হিজরী মুতাবিক ১৮০৬খৃস্টাব্দ) কুরআন মাজীদের কয়েকটি তরজমা সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা যায়। তৎকালীন যুগে সম্পাদিত তরজমাগুলোর মধ্য হতে অন্যতম একটি হচ্ছে ‘তাফসীরে মুরতাযায়ী’ যা পদ্যাকারে শুধু ত্রিশতম পারার তরজমা ও তাফসীর সম্বলিত। সংকলকের নাম শাহ গোলাম মুরতাযায়ী। সংকলকের নমানুসারে এর নামকরণ করা হয় তাফসীরে মুরতাজায়ী। তিনি ১১৯৪ হিজরী মুতাবিক ১৭৮০ খৃস্টাব্দে এ তাফসীর গ্রন্থটি সংকলন করেন। উক্ত তাফসীর গ্রন্থটি ১২৫৯ হিজরী মুতাবিক ১৮৪৩ খৃস্টাব্দে টাইপের অক্ষরে ছাপা হয়।
উর্দূ ভাষার কুরআন কারীমের প্রাচীন তরজমাগুলোর মধ্যে আযীযুল্লাহ হামরাঙ্গ আওরাঙ্গাবাদী কৃত একটি তরজমার কথা জানা যায়, যা শুধু ত্রিশতম পারার তরজমা। অনুরূপভাবে প্রাচীন তরজমাগুলোর মধ্যে ‘তাওযীহে মাজীদ’ নামে সায়্যিদ আলী মুজতাহিদ লাক্ষ্মৌবী র. কৃত আরো একটি তরজমার সন্ধান পাওয়া যায়, যা তাফসীর সহ শাহী ছাপাখানা লাক্ষ্ণৗ হতে ১২৫৩ হিজরী মুতাবিক ১৮৩৯ খৃস্টাব্দে শাসক নওয়াব আমজাদ শাহর শাসনামলে ছাপা হয়েছে। এ তরজমাটি শিয়া দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে লেখা হয়েছিল।
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এসব তরজমার অধিকাংশই এখন আর পাওয়াা যায় না, তাই এগুলোর ভাষা ও বৈশিষ্ট্যাবলী সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ।
মতামত দিন
আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।