কুরআন-নাযিলের-মাস-মাহে- রমজান

কুরআন-নাযিলের-মাস-মাহে- রমজান
কুরআন নাযিলের মাস মাহে রমজানহাফেজ মাওলানা জাহিদুল ইসলাম

পরম মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ মাস মাহে রমজান। এ মাসের মর্যাদার বিস্তারিত বিবরণ উল্লিখিত রয়েছে হাদীসে নববীতে। একেকটি ফরজ আমলের ছাওয়াব সত্তর গুণ বৃদ্ধি পাওয়া, একেকটি নফল আমলের ছাওয়াব ফরজ আমলের ছাওয়াব সমতুল্য হওয়া, মালউন শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকা, জান্নাতকে সুসজ্জিত করা, জাহান্নামের আজাব স্থগিত রাখা ইত্যাদি এ মাসেরই বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া এ মাসেরই অন্তর্ভুক্ত একটি রাতকে (লাইলাতুল

পরম মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ মাস মাহে রমজান। এ মাসের মর্যাদার বিস্তারিত বিবরণ উল্লিখিত রয়েছে হাদীসে নববীতে। একেকটি ফরজ আমলের ছাওয়াব সত্তর গুণ বৃদ্ধি পাওয়া, একেকটি নফল আমলের ছাওয়াব ফরজ আমলের ছাওয়াব সমতুল্য হওয়া, মালউন শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকা, জান্নাতকে সুসজ্জিত করা, জাহান্নামের আজাব স্থগিত রাখা ইত্যাদি এ মাসেরই বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া এ মাসেরই অন্তর্ভুক্ত একটি রাতকে (লাইলাতুল ক্বদরকে) আল্লাহ তা‘আলা হাজার রাত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। মাহে রমজানের এসব ফজীলতের বিবরণ শুনে যে কারো মনেই প্রশ্ন হয়, মাহে রমজানের কেন এত মর্যাদা? উত্তরে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মাহে রমজানে মহান রাব্বুল আলামীন সর্বশেষ আসমানী কিতাব কুরআন নাযিল করেছেন বিধায় এ মাসের এত মর্যাদা।

কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যেমন মহান ও মহিমান্বিত তাঁর পাক কালামও অনুরূপ গুণে গুণান্বিত। আর মর্যাদাপূর্ণ কোন জিনিসের সাথে যখন অন্য জিনিস সম্পৃক্ত হয় তখন সেই জিনিসের মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়ে যায়। পবিত্র কুরআনের নুযূল প্রক্রিয়া মাহে রমজানের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় স্বাভাবিক নিয়মেই এ মাসের মর্যাদা এত বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রশ্ন হতে পারে যে, পবিত্র কুরআনের নুযূল প্রক্রিয়া তো মাহে রমজানে সম্পন্ন হয়নি; বরং ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে অবস্থা ও প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে অল্প অল্প করে তা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং সুদীর্ঘ তেইশ বছর মতান্তরে বাইশ বছর পাঁচ মাস চৌদ্দ দিনে তা সম্পন্ন হয়েছে। তাহলে রমজান মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে কথাটির অর্থ কি?

উপরোক্ত প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব হচ্ছে এই যে, পবিত্র কুরআনের নুযূল প্রক্রিয়া দু’ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। প্রথমত: সম্পূর্ণ কুরআন একবারে ও একত্রে নাযিল হয়েছে। দ্বিতীয়ত: প্রয়োজন ও অবস্থার প্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে দীর্ঘ সময়ে তা অবতীর্ণ হয়েছে। এর বিশ্লেষণ হচ্ছে  নিম্নরূপ,
আল্লাহ তা‘আলার কালাম সমষ্টি আল-কুরআন প্রথমত ‘লওহে মাহফূজ’ এ সংরক্ষিত ছিল।

ইরশাদ হয়েছে-  بَلْ هُوَ قُرْانٌ مَّجِيْدٌ ۞ فِىْ لَوْحٍ مَّحْفُوْظٍ ۞
‘বস্তুত এটা সম্মানিত কুরআন যা সুরক্ষিত ফলকে সংরক্ষিত রয়েছে।’  (সূরাহ বুরূজ: ২১-২২)

সেখান থেকে একত্রে ও একবারে পূর্ণ কুরআন প্রথম আসমানে অবস্থিত ‘বাইতুল ইজ্জাত’ এ নাযিল করা হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘বাইতুল ইজ্জাত’ থেকে অল্প অল্প করে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট অবতীর্ণ হয়েছে। এতদ সংক্রান্ত কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা নি¤œরূপ।

ইরশাদ হয়েছে-  شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىْ اُنْزِلَ فِيْهِ الْقُرْانُ
‘রমজান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে।’ (সূরা বাকারাহ্: ১৮৫)
আরো ইরশাদ হয়েছে- اِنَّا اَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةِ الْقَدْرِ
‘নিশ্চয় আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে।’ (সূরাহ্ ক্বদর: ১)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন যে, কুরআনকে লওহে মাহফূজ হতে পৃথক করে (প্রথমত) প্রথম আসমানে অবস্থিত ‘বাইতুল ইজ্জাত’ এ রাখা হয়েছে। এরপর সেখান থেকে হযরত জিবরাঈল আ. তা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি অবতীর্ণ করেছেন। (আলমুস্তাদরাক লিল হাকিম: ২৮৮১)

এ সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.হতে বর্ণিত অন্যান্য রিওয়ায়াত  নিম্নরূপ,
সমগ্র কুরআন একত্রে দুনিয়ার (নিকটবর্তী) আসমানে অবর্তীণ হয়েছে কদরের রাতে। এরপর সেখান থেকে বিশ বৎসরে অবতীর্ণ হয়েছে।
(আল-মুস্তাদরাক লিল হাকিম: ২৮৭৯)

ইমাম ক্বুরতবী রহ.লওহে মাহফূজ হতে প্রথম আসমানের ‘বাইতুল ইজ্জাত’ এ একত্রে পূর্ণ কুরআন অবর্তীণ হওয়ার বিষয়ে উম্মতের ইজমা’ তথা ঐক্যমতের কথা উল্লেখ করেছেন।’ (তাফসীরে কুরতুবী: ১/৬৭৮)

তবে বাইতুল ইজ্জাত হতে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ধারাবাহিক কুরআন নাযিলের সূচনা কখন হয়েছে এ সম্পর্কিত হাদীস শরীফের বর্ণনা  নিম্নরূপ,
হযরত আবু ক্বাতাদাহ রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সোমবার এমন একটি দিন যেদিন আমি ভূমিষ্ঠ হয়েছি এবং এদিনেই আমার প্রতি কুরআন নাযিল (এর সূচনা) করা হয়েছে। (মুসলিম: ১১৬২)

অনুরূপভাবে আল্লামা ওয়াকিদী রহ. বর্ণনা করেন যে, হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ওহীর সূচনা হয় ১৭ রমজান সোমবার অথবা ২৪ রমজান সোমবার। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ২/৬)

রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রথম রমজানে হযরত ইবরাহীম আ. এর প্রতি সহীফা অবতীর্ণ হয়। ষষ্ঠ রমজানে (হযরত মূসা আ.এর প্রতি) তাউরাত অবতীর্ণ হয়। ত্রয়োদশ রমজানে (হযরত ঈসা আ.এর উপর) ইঞ্জীল অবতীর্ণ হয়,আর চব্বিশে রমজান কুরআন অবতীর্ণ হয়। (মুসনাদে আহমাদ: ৪/১০৭)

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথা স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, সম্পূর্ণ কুরআন একত্রে লওহে মাহফূজ হতে প্রথম আসমানের ‘বাইতুল ইজ্জাত’ এ অবর্তীণ হয়েছে পবিত্র রমজান মাসের কদরের রাত্রে। অনুরূপভাবে বাইতুল ইজ্জাত হতে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ধারাবাহিকভাবে কুরআন নাযিলের সূচনাও হয়েছে রমজান মাসে। এছাড়া ধারাবাহিক কুরআন নাযিলের সূচনা হওয়ার পর থেকে প্রতি বৎসর একবার হযরত জিবরাঈল আ.রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ইতিপূর্বে নাযিলকৃত কুরআনের সূরাহ্ ও আয়াতসমূহের দাওর (পরস্পরকে মুখস্থ শুনানো) করতেন। তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালের বৎসর এ দাওর দু’বার অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
عن ابى هريرة قال كان يعرض على النبى صلى الله عليه وسلم القرآن كل عام مرة فعرض عليه مرتين فى العام الذى قبض فيه
‘হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর একবার কুরআনে কারীম দাওর করতেন। আর ইন্তিকালের বছর কুরআনে কারীম দু’বার দাওর করেছেন।  (বুখারী: হাদীস নং- ৪৯৯৮)

উল্লেখ্য যে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে হযরত জিবরাঈল আ. এর প্রত্যেকটি দাওর অনুষ্ঠিত হয়েছিল রমজান মাসে। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফের বর্ণনা  নিম্নরূপ।
عن ابن عباس قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم أجود الناس وكان أجود مايكون فى رمضان حين يلقاه جبريل وكان يلقاه فى كل ليلة من رمضان فيدارسه القرآن فلرسول الله صلى الله عليه وسلم أجود بالخير من الريح المرسلة
‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচাইতে বেশী দানশীল ছিলেন। আর রমজান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বেশী দানশীল হতেন যখন হযরত জিবরাঈল আ.তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন। আর হযরত জিবরাঈল আ. রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে রমজানের প্রতি রাতেই সাক্ষাত করতেন অতঃপর কুরআনের দাওর করতেন। (বুখারী:৬)

‘তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, মাহে রমজানের সাথে রয়েছে পবিত্র কুরআনের গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক। সেই রমজান মাস সমাগত প্রায়। সুতরাং এ মাসেই আমরা কুরআনের হকসমূহ বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রত্যয়ে, সম্মুখপানে অগ্রসর হই। অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করি, কুরআন বুঝতে চেষ্টা করি, কুরআনের উপর আমল শুরু করি এবং পবিত্র কুরআনের প্রচার-প্রসারে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সহায় হোন। আমীন ॥

চলমান পোষ্ট

মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।

সর্বশেষ পোস্ট

শীর্ষ লেখক

সর্বাধিক মন্তব্য

বৈশিষ্ট্যযুক্ত ভিডিও

ক্যাটাগরি