তা‘জীমে কুরআন ও আমাদের করণীয়

তা‘জীমে কুরআন ও আমাদের করণীয়
তা‘জীমে কুরআন ও আমাদের করণীয়মাওলানা কামরুল ইসলাম মুসা সাহেব, মুদীর মা‘হাদু উলূমিল কুরআন

পবিত্র কুরআনের অন্যতম একটি হক হচ্ছে ‘তা‘জীমে কুরআন’। তা‘জীমে কুরআনের অর্থ পবিত্র কুরআনের আজমত ও বড়ত্বকে অন্তরে যথাযথরূপে স্থান দেওয়া এবং বাহ্যিক আচরণেও কুরআনের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা। কালামুল্লাহ্র প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করার দাবীদারদের উক্ত দু’টি বিষয়ের প্রতিই লক্ষ্য রাখা অপরিহার্য। কেননা, কালামুল্লাহ্র প্রতি কেউ পূর্ণ শ্রদ্ধাবোধ অন্তরে লালন করলেও যদি তার

পবিত্র কুরআনের অন্যতম একটি হক হচ্ছে ‘তা‘জীমে কুরআন’। তা‘জীমে কুরআনের অর্থ পবিত্র কুরআনের আজমত ও বড়ত্বকে অন্তরে যথাযথরূপে স্থান দেওয়া এবং বাহ্যিক আচরণেও কুরআনের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা। কালামুল্লাহ্র প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করার দাবীদারদের উক্ত দু’টি বিষয়ের প্রতিই লক্ষ্য রাখা অপরিহার্য। কেননা, কালামুল্লাহ্র প্রতি কেউ পূর্ণ শ্রদ্ধাবোধ অন্তরে লালন করলেও যদি তার বাহ্যিক আমল এর পরিপন্থী হয়, তাহলে এতে তা‘জীমে কুরআনের দাবীর যথার্থতা প্রমাণিত হয় না। কেননা অনেক ক্ষেত্রে মানুষ লৌকিকতা বশত: অথবা দুনিয়াবী কোন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেও অন্তরের চাহিদার বিপরীত কাজ করে থাকে। সুতরাং কুরআনের তা‘জীমের জন্য উক্ত দু’টি বিষয়ই অপরিহার্য। এর ব্যতিক্রম হলে কালামুল্লাহ্র তা‘জীমের হক আদায় হবে না। তাই কোনরূপ শিথিলতা বা অবহেলা না করে কালামুল্লাহ্র যথাযথ তা‘জীম করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।
আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, মানুষের নিকট পৃথিবীর বস্তুসমূহের মধ্য হতে সর্বাধিক মর্যাদা প্রাপ্তির বস্তু হচ্ছে আল-কুরআন। কারণ, আল-কুরআন হচ্ছে, সরাসরি মহান আল্লাহর পূত-পবিত্র সত্তার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। আর আল্লাহ পাক যেমন মহান ও মহিমান্বিত তাঁর পবিত্র কালামও অনুরূপ গুণে গুণান্বিত। পবিত্র কুরআন এত অধিক মর্যাদা সম্পন্ন হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে তা আল্লাহ্ কালাম। তদুপরি রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনের শতাধিক আয়াতে এ মহান গ্রন্থের আজমত ও মর্যাদা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। সেগুলোর মধ্য হতে এখানে মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা হল।

ইরশাদ হয়েছে,  لَقَدْ اتَيْنكَ سَبْعًا مِّنَ الْمَثَانِى وَالْقُرْانَ الْعَظِيْمَ
‘নিশ্চয় আমি তোমাকে বার বার পঠিত সাত আয়াত ও মহান কুরআন প্রদান করেছি।’ (সূরাহ হিজর: ৮৭)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
اِنَّه لَقُرْانٌ كَرِيْمٌ۞ فِىْ كِتبٍ مَّكْنُوْنٍ۞ لاَيَمَسُّه اِلاَّالْمُطَهَّرُوْنَ۞ تَنْزِيْلٌ مِّنْ رَّبِّ الْعلَمِيْنَ۞ ‘নিশ্চই এটা সম্মানিত কুরআন যা সুরক্ষিত কিতাবে আছে। যারা পূত পবিত্র তারা ব্যতিত অন্য কেউ তা স্পর্শ করে না। যা জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।’ (সূরাহ্ ওয়াক্বিয়া: ৭৭-৮০)

আরো ইরশাদ হয়েছে,  اِنَّه فِىْ اُمِّ الْكِتبِ لَدَيْنَا لَعَلِىٌّ حَكِيْمٌ ۞  নিশ্চয় এটা (কুরআন) আমার নিকট উম্মুল কিতাবে (মূল গ্রন্থ তথা লাওহে মাহফূজে ) রয়েছে, এটা মহান, জ্ঞানগর্ভ। (সূরাহ্ যুখরুফ:৪)
সুতরাং আমাদের কারো দ্বারা যেন পবিত্র কুরআনের তা‘জীম পরিপন্থী কোন কাজ কখনো প্রকাশ না পায়, সেজন্য সর্বদা সতর্ক থাকা কর্তব্য। কুরআনের তা‘জীমের হক যথাযথভাবে আদায়ের জন্য সর্বসাধারণের এ বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন বিধায় এখানে এ সংক্রান্ত আলোচনা করা হল।
কুরআনকে উঁচু জায়গায় রাখা, চুমু খাওয়া ও কুরআন খানি করা এ সবকেই তা‘জীমে কুরআন এর হক আদায়ের জন্য যথেষ্ট মনে করা চরম বোকামি ছাড়া কিছু নয়, বরং আল-কুরআনের প্রতি যথাযথ তা‘জীম প্রদর্শনের নিমিত্তে সর্বাগ্রে কালামুল্লাহ্র হকগুলো পালনে যতœবান হওয়া আবশ্যক। তিলাওয়াতে কুরআন কালামুল্লাহ্র অন্যতম একটি হক ।

এ মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদে হয়েছে,  اُتْلُ مَااُوْحِىَ اِلَيْكَ مِنَ الْكِتبِ
‘তুমি কিতাব থেকে পাঠ কর যা তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়।’  (সূরাহ্ আনকাবূত: ৪৫)

অনুরূপভাবে অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,  فَاقْرَؤُوْا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ
‘সুতরাং তোমরা কুরআনের যতটুকু সহজ হয় ততটুকু পাঠ কর।’  (সূরাহ মুয্যাম্মিল: ২০)

কুরআনের প্রতিটি হরফ তিলাওয়াতে দশটি নেকী লাভ হয়। এর দ্বারা অন্তরের কালিমা দূর হয়ে নূর সৃষ্টি হয়। সুতরাং এসব বিষয় চিন্তা করে আমাদের নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা কর্তব্য। কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে তিলাওয়াতের আদবের প্রতি লক্ষ্য রাখাও তা‘জীমের কুরআনের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তিলাওয়াতের বিশুদ্ধতার প্রতি লক্ষ্য না রেখে অশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত করা, দ্রুত তিলাওয়াত করা, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতি লক্ষ্য না রেখে তিলাওয়াত করা , কুরআন খোলা রেখেই তিলাওয়াতরত অবস্থায় অন্যের সাথে কথা বলা, এমন স্থানে উচ্চ স্বরে তিলাওয়াত করা যেখানে মানুষ কর্ম ব্যস্ত থাকে অথবা অন্য কোন কারণে তিলাওয়াতের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ না পায়। তেমনিভাবে মাইকে শবীনা বা কুরআন খতম করা ইত্যাদি বিষয়াদি যেমন কুরআন তিলাওয়াতের হক পরিপন্থী, তেমনিভাবে এসব আচরণ তা‘জীমে কুরআনেরও সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
প্রসঙ্গক্রমে কুরআন শ্রবণের বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। কুরআনের আয়াতসমূহ তিলাওয়াত কালে নিশ্চুপ হয়ে গভীর মনোযোগ সহকারে তা শ্রবণ করা আল্লাহ পাকের হুকুম। অথচ দেখা যায় বর্তমানে বিভিন্ন মাহফিলে-মজলিসে অথবা এককভাবে যখন কারো কাছে বসে কুরআন তিলাওয়াত করা হয় তখন আমরা তিলাওয়াতের প্রতি লক্ষ্য না করে আলাপচারিতায় বা কথবার্তায় লিপ্ত থাকি এটা তা‘জীমে কুরআনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী কাজ। সুতরাং কুরআন তিলাওয়াত কালে যদি আমাদের একান্ত জরুরী কোন কথা বলতেই হয় তাহলে সেই মজলিসে অথবা সেই স্থান ত্যাগ করে একটু দূরে গিয়ে আমাদের জরুরী কথা শেষ করতে পারি। আর যদি মজলিস ত্যাগ করা সম্ভব না হয় তাহলে তা‘জীমে কুরআনের প্রতি লক্ষ্য রেখে কথাবার্তা পরিহার করে মনোযোগসহ কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করা উচিত।
পবিত্র কুরআনের আরেকটি হক হচ্ছে তাদাব্বুরে কুরআন তথা কুরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ফিকির করা।

এ মর্মে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন,  اَفَلاَيَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْانَ اَمْ عَلى قُلُوْبٍ اَقْفلُهَا ۞  ‘তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে না, নাকি তাদের অন্তরসমূহ তালাবদ্ধ?’ (সূরাহ্ মুহাম্মদ: ২৪)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,  تبٌ اَنْزَلْنهُ اِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوْا ايَتِه وليتذكر اولوالألباب
‘এক কল্যাণময় কিতাব এটা আমি তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছি যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে। (সূরাহ্ সাদ: ২৯)

এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআনে বর্ণিত বিষয় সম্পর্কে তাদাব্বুর করার জন্য প্রথমত: সাধারণভাবে কুরআন বুঝা অপরিহার্য। তবে কুরআন বুঝা ও তাদাব্বুর করা উভয় ক্ষেত্রেই সলাফে সালিহীন ও আকাবিরদের তরীকা অবলম্বন করা ও তাফসীর শাস্ত্রের নীতিমালা অনুসরণ করা অপরিহার্য। আর এর বিপরীত করা যে কেবল তা‘জীমে কুরআনের পরিপন্থী কাজ হবে তা-ই নয়; বরং এর ফলে কুরআনের অর্থগত বিকৃতিও ঘটবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, তাদাব্বুরে কুরআন কালামুল্লাহ্র অন্যতম একটি হক হলেও সকলের জন্য তাদাব্বুর করা জরুরী নয়। বরং কুরআনে তাদাব্বুর করার জন্য প্রয়োজণীয় জ্ঞান অর্জনকারী ব্যক্তিবর্গই কেবল এতে মনোনিবেশ করবেন। কারণ, কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বুঝার জন্য প্রয়োজণীয় জ্ঞান আহরণ ব্যতিত তাদাব্বুরের মাধ্যমে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছা যাবে না। সুতরাং সর্বসাধারণ শ্রেণী নিজেরা কুরআনে তাদাব্বুরে লিপ্ত না হয়ে কুরআনী জ্ঞানে পারদর্শী হক্কানী আলিমেদ্বীনের তাদাব্বুর লব্ধ বিষয়ের অনুসরণ করবেন। তবে সাধারণ শ্রেণীর জন্য কুরআন তাফসীর গ্রন্থ পাঠ করে কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বুঝা নিষেধ নয়। তারা সেটা অবশ্যই করবেন। তবে তাও হতে হবে হক্কানী আলিমে দ্বীনের দিক-নির্দেশনা ও পরামর্শের ভিত্তিতে। অন্যথায় এক্ষেত্রেও সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সমূহ আশংকা থাকে। আর তা হবে তা‘জীমে কুরআনের একেবারে পরিপন্থী কাজ।
পবিত্র কুরআনের অন্যতম একটি হক হচ্ছে, ইত্তিবায়ে কুরআন। এটাই হচ্ছে কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য।

কুরআনের ইত্তিবা সম্পর্কে আল্লাহ পাকের ঘোষণা নিম্নরূপ- وَهذَا كِتبٌ اَنْزَلْنهُ مُبرَكٌ فَاتَّبِعُوْهُ وَاتَّقُوْا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ ۞
‘এ কিতাব যা আমি নাযিল করেছি যা কল্যাণময়। সুতরাং তোমরা এর অনুসরণ কর এবং সাবধান হও। অবশ্যই তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে।’
(সূরাহ্ আন‘আম: ১৫৫)

ইত্তিবায়ে কুরআনের অপরিহার্যতা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এসবের মধ্য হতে কোন একটি ক্ষেত্রেও আল-কুরআনের ইত্তিবার বিকল্প নেই। অথচ আজ আমরা ব্যক্তি জীবনে কুরআনের আংশিক ইত্তিবা করেই কুরআনের ইত্তিবার হক আদায় করে চলছি এবং এতদসংশ্লিষ্ট কুরআনের তা‘জীমও করছি বলে ধারণা করছি। আমাদের এ ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক ও অন্তসারশূন্য। কেননা, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইত্তিবায়ে কুরআনের সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করা ব্যতিত এ ক্ষেত্রে আমাদের দ্বারা ক্রুআনের হক আদায় হবে না এবং কুরআনের তা‘জীমও হবে না।
তেমনিভাবে কুরআনের আরেকটি বিশেষ হক হচ্ছে, ইশা‘আতে কুরআন ও তাবলীগে কুরআন।

এ মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- وَاَنْزَلْنَا اِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَانُزِّلَ اِلَيْهِمْ
‘আর আমি তোমার প্রতি যিক্র তথা কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দাও, তাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে।’
(সূরাহ্ নাহ্ল: ৪৪)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
وَاُوْحِىَ اِلَىَّ هذَا الْقُرْانُ لاُِنْذِرَكُمْ بِه وَمَنْ بَّلَغَ   ‘এ কুরআন আমার নিকট প্রেরণ করা হয়েছে যাতে তোমাদেরকে এবং যাদের নিকট এ কুরআন পৌঁছবে তাদেরকে এর দ্বারা আমি সতর্ক করি।’  (সূরাহ্ আন‘আম: ১৯)
কুরআনকে স্পষ্টরূপে বুঝিয়ে দেওয়া ও মানুষের নিকট কুরআনের বাণী পৌঁছানোর এ দায়িত্ব উম্মতের উপর অর্পিত। আয়াতে যদিও সরাসরি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, কিন্তু এর দ্বারা উদ্দেশ্য উম্মতও। কারণ, পবিত্র কুরআনের বহুসংখ্যক আয়াতে উম্মতের উপর কোন বিধান আরোপ করা হয়েছে, অথচ সেক্ষেত্রে উম্মতকে সম্বোধন করার পরিবর্তে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সম্বোধন করা হয়েছে। উল্লিখিত আয়াতেও তাই হয়েছে। পবিত্র কুরআনের অন্য আয়াত দ্বারাও এ বিষয়টি প্রমাণিত হয় যে, তাবলীগের এ দায়িত্ব উম্মতের উপর অর্পিত।

ইরশাদ হয়েছে-  قُلْ هذِه سَبِيْلِىْ اَدْعُوْا اِلَى اللهِ عَلى بَصِيْرَةٍ اَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِىْ وَسُبْحنَ اللهِ وَمَا اَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ ۞
‘আপনি বলুন এটা আমার পথ। আমি মানুষকে আল্লাহ্র দিকে আহ্বান করি সজ্ঞানে এবং আমার অনুসারীগণও। আল্লাহ্ মহিমান্বিত আর যারা আল্লাহ্ তা‘আলার শরীক করে আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ (সূরাহ্ ইউসূফ: ১০৮)

সুতরাং উম্মতের মধ্য হতে প্রত্যেকের কর্তব্য যে, যখন যার মাধ্যমে যেভাবে সম্ভব ইশা‘আতে কুরআন ও তাবলীগে কুরআনের এ মহান খিদমাত আঞ্জাম দেওয়া। সরাসরি জড়িত হয়ে, অর্থ ব্যয় করে,বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে, আন্তরিক দু‘আর মাধ্যমে অর্থাৎ যখন যতটুকু সম্ভব হয় তা-ই করা আমাদের প্রতি পবিত্র কুরআনের অন্যতম দাবী। আর আমাদের সামন্য গাফলতির কারণে যদি কুরআনের প্রচার-প্রসার বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে হাশরের কঠিন ময়দানে অবশ্যই এর জন্য জওয়াবদিহী করতে হবে। আর সুযোগ ও সামর্থ থাকার পরও ইশাআতে কুরআন থেকে দূরে থাকা যে তা‘জীমে কুরআনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং কালামুল্লাহ্র প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা প্রদর্শন, তা বলা বাহুল্য।
তা‘জীমে কুরআনের দাবীদারদের জন্য কুরআনের এ সব হক আদায়ের সাথে সাথে কালামুল্লাহ্র অমর্যাদা হয় এবং এর প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ পায় এমনসব বিষয় আগে নিজেদের সম্পূর্ণ পরিহার করা এবং অন্য কারো মাধ্যমে অনুরূপ কোন আচরণ প্রকাশ পেলে তা প্রতিহত করার জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করাও অপরিহার্য।
উল্লেখ্য যে, আজ এক শ্রেণীর লোক কুরআন তিলাওয়াত সহজ করণের মানসিকতায় বাংলা-ইংরেজী অক্ষরে কুরআন মুদ্রণ করছে। আর এটাকে কুরআনের খিদমাত ও কুরআনের প্রতি তা‘জীম বলে ধারণা করছে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ও অবাস্তব ধারণা। বরং এর মাধ্যমে কুরআন বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং তা‘জীমে কুরআন এর হক আদায়ের জন্য এমন জঘন্য অপরাধ থেকে তাওবাহ করা এবং অন্যদের এর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করা জরুরী।
এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়, আয়াতবিহীন কুরআন লিখনের কথা। আজ বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কুরআনের আয়াত ব্যতিরেকে স্বতন্ত্রভাবে কেবল অনুবাদ মুদ্রণ করছে। আর এটাকেও কুরআনের এক ধরনের খিদমাত মনে করা হচ্ছে। অথচ তা হচ্ছে জঘন্য অপরাধ। পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলোতে বিকৃতি এভাবেই শুরু হয়েছিল। তা‘জীমে কুরআনের দাবীদারদের এক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। তেমনিভাবে বর্তমানে ক্যালেন্ডারে, ঈদ কার্ডে, বিশেষ উৎসব উপলক্ষে প্রেরীত পত্রে কুরআনী আয়াতের ক্যালিগ্রাফী এবং পোস্টারে, ফেস্টুনে, সাইনবোর্ডে, দা‘ওয়াত পত্রে,প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রামে কুরআনী আয়াতের ব্যবহার দেদারছে হচ্ছে। আমরা এগুলোকে কুরআনের তা‘জীম হিসাবে বিবেচনা করছি। অথচ এসবের দ্বারা যে কুরআনের বেহুরমতি হচ্ছে, সেটা কি আমরা ঘুর্ণাক্ষরেও চিন্তা করছি? কুরআনী আয়াত উৎত্তীর্ণ ক্যালেন্ডার সময় শেষে মানুষ যত্রতত্র ফেলে রাখে, ময়লা-আবর্জনার সাথে ফেলে রাখে অনেকে। ঈদ কার্ডের অবস্থাও তো তাই। পোস্টার-ফেস্টুন অনেক সময় পড়ে থাকে ড্রেনে। অথচ তাতে লিখিত থাকে পাক কুরআনের আয়াত। আর সাইনবোর্ডের উপর পাখি বসে বিষ্টা নিক্ষেপ করে। বাড়ীর দেওয়ালে, বাসের গায়ে এরূপ আরো বিভিন্ন স্থানে কুরআনী আয়াতের প্রয়োগ ক্রমশ: বৃদ্ধি পেতে চলেছে। সন্দেহ নেই যে, কুরআনের আজমত অন্তরে লালন করেই আমরা এসব করছি; কিন্তু এর মাধ্যমে যে কুরআনের বেহুরমতি ও অবমাননা হচ্ছে তা কি আমরা চিন্তা করে দেখেছি? মাবাইল ফোনের রিংটোন হিসাবে কুরআনী আয়াতের ব্যবহার সচরাচর পরিলক্ষিত হয়। কুরআনের প্রতি মুহাব্বত ও তা‘জীমের কারণে এটা হয়ে থাকে সন্দেহ নেই। কিন্তু বাথরূমে যাওয়ার পর যখন কারো মোবাইল ফোনে কুরআনী আয়াত শোনা যায়, তখন আর আফসোসের অন্ত থাকে না। এটাকে আখ্যায়িত করা যায়, মূর্খ বন্ধুর কাজ হিসাবে। সুতরাং এটা যে তা‘জীমে কুরআন নয়, সেটা অবশ্যই বুঝা উচিত। আমাদের বাসা-বাড়ীতে কুরআনের কপি অবহেলা আর অনাদরে রাখা থাকে। দীর্ঘ দিন পর্যন্ত তিলাওয়াত না করা অবস্থায় রেখে দেওয়ার কারণে মলাটের উপর ধূলা-বালি জমে যায়। বিভিন্ন জায়গায় মসজিদগুলোর তাকে দেখা যায় ছেঁড়া-ফাঁটা কুরআনের কপি, কুরআনের ছেঁড়া পাতা, আর কুরআনের কপিগুলোও রাখা থাকে গিলাফবিহীন অবস্থায়। সে কি করুণ দৃশ্য! অথচ কুরআনের কপিগুলো সযত্নে পূর্ণ আদব-ইহতিরাম ও ভক্তি-শ্রদ্ধা সহকারে গিলাফ আবৃত করে স্বর্ণালংকারের চেয়েও অনেক বেশী গুরুত্ব দিয়ে উঁচু জায়গায় রাখাই হচ্ছে তা‘জীমে কুরআনের দাবী। তেমনিভাবে কুরআনের ছেঁড়া-ফাঁটা ও তিলাওয়াতের অযোগ্য কপি ও কুরআনের ছেঁড়া পাতা বা টুকরা অত্যন্ত আদব ইহতিরামের সাথে পবিত্র কাপড় পেঁচিয়ে কবরস্তানঅথবা অন্য কোন সংরক্ষিত স্থানে দাফন করা তা‘জীমে কুরআনের জন্য অপরিহার্য। এমনিভাবে কোন ক্ষেত্রে কোনভাবেই যেন আমাদের দ্বারা কালামুল্লাহ্র প্রতি সামান্যতম বেহুরমতি, অবহেলা ও উদাসীনতা প্রকাশ না পায়, সেজন্য সতর্ক থাকা জরুরী। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তা‘জীমে কুরআনের হক যথাযথরূপে আদায় করার তাওফীক দান করুন।

 

চলমান পোষ্ট

মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।

সর্বশেষ পোস্ট

শীর্ষ লেখক

সর্বাধিক মন্তব্য

বৈশিষ্ট্যযুক্ত ভিডিও

ক্যাটাগরি