তাফসীর বিদদিরায়াহ এর মাঝে অন্যতম একটি তাফসীর গ্রন্থ হলো: الكشاف عن حقائق التنزيل وعيون الأقاويل فى وجوه التأويل (অর্থ: (এটা) কুরআন কারীমের দুর্বোধ্য মূল অর্থ ও কুরআন ব্যাখ্যার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ সংশ্লিষ্ট বক্তব্যের মূল মূল অংশ উদঘাটনকারী) এটা এ তাফসীর গ্রন্থের মূল নাম হলেও এ কিতাবটি সংক্ষেপে তাফসীরে কাশ্শাফ হিসেবেই অধিক প্রসিদ্ধ। লেখক পরিচিতি: জগদ্বিখ্যাত এ
তাফসীর বিদদিরায়াহ এর মাঝে অন্যতম একটি তাফসীর গ্রন্থ হলো: الكشاف عن حقائق التنزيل وعيون الأقاويل فى وجوه التأويل (অর্থ: (এটা) কুরআন কারীমের দুর্বোধ্য মূল অর্থ ও কুরআন ব্যাখ্যার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ সংশ্লিষ্ট বক্তব্যের মূল মূল অংশ উদঘাটনকারী) এটা এ তাফসীর গ্রন্থের মূল নাম হলেও এ কিতাবটি সংক্ষেপে তাফসীরে কাশ্শাফ হিসেবেই অধিক প্রসিদ্ধ।
লেখক পরিচিতি:
জগদ্বিখ্যাত এ তাফসীর গ্রন্থের সম্মানিত লেখক হলেন আল ইমাম, আবূল কাসেম, জারুল্লাহ, মাহমূদ বিন উমার বিন মুহাম্মদ বিন উমার, আল-খুওয়ারিয্মী, (خُوَارِزْمِيْ : أوله بين الضمة والفتحة والألف مسترقة محتلسة ليست بألف صحيحة هكذا يتلفظون به.) (معجم البلدان)
আয-যামাখশারী। খুরাসানের অন্তর্গত খুওয়ারিয্ম এলাকায় জন্ম গ্রহণের কারণে খুওয়ারিয্মী আর খুওয়ারিয্ম এলাকার অন্তর্গত যামাখশার অঞ্চলে জন্ম গ্রহণের কারণে যামাখশারী বলা হয়। তিনি মক্কা মুকাররমায় বাইতুল্লাহর নিকট কয়েক বৎসর অবস্থানের কারণে তাঁকে ‘জারুল্লাহ’ উপাধি দেয়া হয়।
জন্ম ঃ তিনি চারশত সাতষট্টি (৪৬৭) হিজরীর সাতাশ (২৭) রজব বুধবার যামাখশার অঞ্চলে জন্মলাভ করেন এবং পাঁচশত আটত্রিশ (৫৩৮) হিজরীর ৯ জিলহজ্জ খুওয়ারিযম এর রাজধানী জিরজানিয়ায় একাত্তর (৭১) বৎসর বয়সে ইহধাম ত্যাগ করেন।
শিক্ষা ঃ তিনি হিফজুল কুরআনসহ ইলমে দ্বীনের প্রাথমিক শিক্ষা তারঁ পিতা হযরত উমার রহ. এর নিকট অর্জন করেছেন এবং খুওয়ারিয্ম, বুখারার যুগশ্রেষ্ঠ উলামায়ে কিরামের নিকট ইলম অর্জন করেন। শৈশব থেকেই তার পা কাটা ছিল। ফকীহ দামেগানী হানাফী রহ. তাঁকে এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন মায়ের বদ দু‘আ অর্থাৎ শৈশবে আমি একটি চড়–ই পাখি আটকিয়ে সূতা দিয়ে পা বেধে রেখেছিলাম। পাখিটি আমার হাত থেকে পালিয়ে যায়। অতপর আমি সেটি এক গর্তে পেয়ে সূতা ধরে এমন টান দিয়েছি যে, চড়–ই পাখিটির পা ছিড়ে গিয়েছে। ফলে আমার মা কষ্ট পেয়ে বলেছেন : قطع الله رِجل الأبعد كما قطعتَ رجلَه
অতপর যখন আমি ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে বুখারা সফর করলাম তখন বাহন জন্তু থেকে পড়ে গিয়ে আমার পা ভেঙ্গে গেল। এরপর বাধ্য হয়ে আমার পা কেটে ফেলতে হলো।
রচনাঃ তিনি ইলমুল লুগাহ, ইলমুল আদব, ইলমুন নাহুসহ আরো বিভিন্œ বিষয়ের উপর পঞ্চাশের কাছাকাছি কিতাব রচনা করেছেন। তিনি অধিকাংশ কিতাব মসজিদে হারামের নিকট লিখেছেন। এগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য হল তাফসীরে কাশ্শাফ। ঐতিহাসিকগণের কেউই তাঁর ব্যাপারে ই‘তিযাল ব্যতিত কোন দোষারোপ করেননি। ইবনে হাজার আসকালানী রহ. তাঁর ব্যাপারে বলেন যে, তিনি সৎ লোক কিন্তু ই‘তিযালের দিকে আহ্বানকারী। তিনি বাদশাহ ও আমীর-উমারাদের সাথে মেলামেশা করতেন, তাদের প্রশংসা করতেন, তাদেরকে ন্যায়-নীতির দিকে ডাকতেন এবং নসীহত করতেন। ৪৫ বৎসর বয়সে মরণাপন্ন রোগে আক্রান্ত হন। রোগ মুক্তির পর আমীর-উমারাদের মজলিস ছেড়ে ই‘তিযালকে প্রাধান্য দেন এবং ইলমে দ্বীন অর্জন ও লেখনীর কাজে মশগুল হন। তিনি বলেন, আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে, আমার পা বাদশাহদের চৌকাঠ অতিক্রম করবে না এবং আমি তাদের প্রশংসা বৃদ্ধি করব না। আর আমি কেবল ইলম শিখা-শিখানো ও গ্রন্থ রচনার কাজে লিপ্ত থাকব। আল্লামা যামাখশারী রহ. সম্পর্কে কয়েকটি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। যেমন: ১. আয-যামাখশরী লেখক: ড. আহমাদ মুহাম্মদ হুফী। যা ১৯৬৬ ইং সনে মিশর থেকে মুদ্রিত হয়েছে। ২. মানহাজুয যামাখশারী, লেখক: ড. মুস্তফা সাবী, জুওয়ায়নি, যা মিশর থেকে মুদ্রিত হয়েছে। ৩. শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবূগুদ্দাহ রহ. কর্তৃক রচিত কিতাব ‘আল-উলামাউল উয্যাব আল্লাযীনা আ-সারুল ইলমা আলাযযিওয়াজ’ এর মাঝে আল্লামা যামাখশারী রহ. এর চমৎকার জীবনী উল্লেখ করেছেন। আল্লামা যামাখশারী রহ. এর প্রশংসায় কোন কবি বলেছেন:
مافهم القرآن إلاالأعرجان أحدهما الزَمخشري والآخر جرجان
কিতাব পরিচিতিঃ
আল্লামা যামাখশারী রহ. বলেন, যখন আমি দেখলাম যে, আরবী ও উসূলে দ্বীন সংক্রান্ত জ্ঞান সমন্বয়কারী আমার কিছু (মু‘তাযিলা ফিরকার) দ্বীনি ভাই যখনই কুরআন কারীমের কোন আয়াতের তাফসীর এর ব্যাপারে আমার শরণাপন্ন হয়, আর আমি তাদেরকে সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বিষয়গুলো বলে দেই, তখন তারা সেটাকে ভাল মনে করে ও বিস্মিত হয়। এরপর তারা নিজেদের আগ্রহ প্রকাশ করে এমন এক রচনার প্রতি যা এ জাতীয় সব বিষয়গুলোর সমন্বয়কারী হবে। এমনকি তারা আমার নিকট সমবেত হয়ে এ ব্যাপারে আবেদন করল যে, তাদের জন্য الكشف عن حقائق التنزيل ، وعيون الأقاويل فى وجوه التأويل লেখা হোক। আমি তাদের নিকট অব্যাহতি কামনা করলে তারা আবেদন অব্যাহত রাখল এবং দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের (মু‘তাযিলা উলামাদের) দ্বারা এ ব্যাপারে সুপারিশ করাল যাদের সুপারিশ গ্রহণ করা আমার জন্য ফরযে আইনের মত। (কুরআন কারীমের তাফসীরকে) ইলমুল মা‘আনী ও ইলমুল বয়ান এর উপর ভিত্তি স্থাপন করা যায় এমন কালামের দিকে উন্নত করা তো দূরের কথা এ ইলম (ইলমুল মা‘আনী ও ইলমুল বয়ান) এর সহায়ক বিষয়াদি ব্যবস্থা করার ব্যাপারে আহলে যামানার দুরাবস্থা, দক্ষ লোকের স্বল্পতা ও তাদের হীনমন্যতা থেকে আমি যা প্রত্যক্ষ করলাম তা আমার অব্যাহতি কামনা আরো তীব্র করে দিল।
অতপর আমি তাদের জন্য কুরআন কারীমের তাফসীর বিষয়ক প্রাথমিক কিছু কথা ও সূরা বাকারার হাক্বীকত বিশ্লেষণে বিশ্লেষণমূলক কিছু তাত্ত্বিক আলোচনা লিখলাম যা ছিল অনেক প্রশ্ন-উত্তর ও টীকা-টীপ্পনী সম্বলিত। এর দ্বারা আমি তাদেরকে অবগত করতে ইচ্ছা করলাম এ শাস্ত্রের অনেক কঠিন কঠিন বিষয়ের প্রতি।
অতপর যখন আমার দৃঢ় ইচ্ছা হলো বাইতুল্লায় গমন ও অবস্থানের তখন আমি মক্কা অভিমূখে রওয়ানা হয়ে গেলাম। আর আমি আমার অতিক্রমের প্রত্যেক শহরে শহর বাশিকে পেলাম যে, তারা আমার লিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত হতে অতি উৎসাহী হয়ে সন্ধান করছে এবং কৌতুহলী হয়ে সংগ্রহের চেষ্টা করছে। অতপর আমি উপলব্ধি করলাম যে, আমার শরীর কেঁপে উঠল ও আমার শান্ত মন নাড়া দিয়ে উঠল। এরপর আমি আমার বিশ্লেষণমূলক লেখার পদ্ধতিকে সংক্ষিপ্ত করে লিখতে আরম্ভ করলাম।
আল্লামা যামাখশারী রহ. এর জীবনের ষাট বছর অতিক্রম হলে মসজিদে হারামের নিকটে তাফসীরে কাশ্শাফ রচনা শুরু করেন ও দু’ বৎসরের কিছু বেশি সময়ে লেখার কাজ সম্পন্ন করেন। আল্লামা যামাখশারী রহ. তাফসীরে কাশ্শাফ লেখা শেষ করে এর জন্য এমন এক নাম চয়ন করেছেন যা এ কিতাবের মানহাজের উপর দালালাত করে। الكشاف عن حقائق غوامض التنزيل وعيون الأقاويل فى وجوه التأويل (অর্থ : কুরআন কারীমের দুর্বোধ্য মূল অর্থ ও কুরআন ব্যাখ্যার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ সংশ্লিষ্ট বক্তব্যের মূল মূল অংশ উদঘাটনকারী)
তাফসীরে কাশ্শাফের প্রশংসা এ পংতি দ্বারা বুঝা যায়:
إنَّ التفاسير في الدنيا بلاعدد وليس فيها لعمرى مثل كشافى
إنْ كنتَ تبغي الهدى فالْزم قِرائته فالجهل كالداء والكشاف كالشافى
পরবর্তী অনেক মুফাসসিরীনে কেরাম তাফসীরে কাশ্শাফ এর উপর নির্ভর করেছেন এবং তাফসীরে কাশ্শাফ থেকে তাফসীর গ্রহণ করেছেন ও কোন কোন মুফাসসির তাফসীরে কাশ্শাফ এর ই‘তিযালী মাযহাব সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো উল্লেখ করে তার খন্ডন করেছেন।
যেসকল তাফসীরের মাঝে তাফসীরে কাশ্শাফ এর প্রভাব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়:
১. মাফাতীহুল গাইবঃ
আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী রহ.(মৃত: ৬০৪, ৬০৫, ৬০৬) তাফসীরে কাশ্শাফ থেকে আল্লামা যামাখশারী রহ. এর ইলমুল বালাগার সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম কিছু বিষয় গ্রহণ করেছেন।
২. তাফসীরে গারায়ীবুল কুরআন ও রাগায়ীবুল ফুরক্বান ঃ
আল্লামা নিযামুদ্দীন হাসান বিন মুহাম্মদ বিন হুসাইন আল-ক্বিম্মী রহ. (মৃত:৭২৮হি.) মূলত তাফসীরে কাশ্শাফ ও তাফসীরে মাফাতীহুল গাইব এর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো একত্রিত করেছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে কিছু সংযোজন করেছেন। তবে তাফসীরে ক্বিম্মী এর মাঝে তাফসীরে কাশ্শাফ এর সারাংশ রয়েছে।
৩. তাফসীরে বাহরুল মুহীতঃ
ইমাম আবূ হায়্যান রহ. (মৃত:৭৫৪ হি.) আল্লামা যামাখশারী রহ. ও ইমাম ইবনে আতীয়া রহ. (মৃত্যু:৫৪১) এর অনেক প্রশংসা করেছেন এবং তাঁদের তাফসীর ‘তাফসীরে কাশ্শাফ ও তাফসীরে ইবনে আতীয়া বা আল-মুহাররারুল ওয়াজিযকে শ্রেষ্ঠ তাফসীর আখ্যায়িত করেছেন।
আবূ হায়্যান রহ. যামাখশারী রহ. এর ভূয়ষী প্রশংসা করা সত্ত্বেও অনেক স্থানে তার সমালোচনা করেছেন এবং তার ব্যাপারে কঠোর ভাষায় মন্তব্য করেছেন। এটা হল আল্লামা যামাখশারী রহ. এর আহলুস সুন্নাহর সাথে তার অযাচিত আচরণের প্রতিদান। কারণ যামাখশারী রহ. তাদের ব্যাপারে অনেক কঠোর ভাষা প্রয়োগ করেছেন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ইমাম আবূ হায়্যান রহ. কে যামাখশারী রহ. এর জন্য নির্বাচন করেছেন যে, তিনি হুবহু তার ভাষায়ই তার জওয়াব দিয়েছেন।
৪. আদ-দুররুল মাসূন ফী উলূমিল কিতাবিল মাকনূনঃ
ইমাম শিহাবুদ্দীন আবুল আব্বাস বিন ইউসূফ বিন মুহাম্মদ আস-সামীন আল-হালাবী (মৃত:৭৫৬হি:) তাফসীরে কাশ্শাফ এর উপর অনেক নির্ভর করেছেন এবং আল্লামা যামাখশারী ও ইমাম আবূ হায়্যান রহ. এর মাঝে বিরোধী বিষয়ে নিজেকে মিমাংসাকারী ভূমিকায় রেখেছেন। অনেক স্থানে আল্লামা যামাখশারী রহ. কে সাহায্য করেছেন এবং ইমাম আবূ হায়্যান রহ. এর পক্ষ থেকে যামাখশারী রহ. এর তীব্র বিরোধিতার খন্ডন করেছেন।
৫. তাফসীরে আনওয়ারুত্তানযীল ওয়া আসরারুত্তাবীলঃ
আল্লামা কাযী নাসিরুদ্দীন বায়যাবী রহ. (মৃত:৭৯১) নিজের লক্ষ্য বানিয়েছেন তাফসীরে কাশ্শাফকে সংক্ষিপ্ত করা, যামাখশারী রহ. এর ই‘তিযালকে বাদ দিয়ে তারঁ তাফসীরী বর্ণনার বিশ্লেষণ ও ইলমুল বালাগাতকে অবশিষ্ট রাখা।
৬. তাফসীরে মাদারিকুত্তানযীল ওয়া হাক্বায়িকুত্তাবীলঃ
আবুল বারাকাত আব্দুল্লাহ ইবনে আহমাদ বিন মাহমূদ আন-নাসাফী রহ. (মৃত: ৭১০ হি:) মূলত তাফসীরে কাশ্শাফ ও তাফসীরে বায়যাবীর সংক্ষেপ করেছেন এবং তাফসীরে কাশ্শাফ এর ই‘তিযাল থেকে বিরত থেকেছেন।
৭. তাফসীরে ইরশাদুল আকলিস সালীম ইলা মাযায়াল কুরআনিল কারীমঃ
কাযী মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুস্তফা আল-হানাফী রহ. (মৃত:৯৮২ হি:) উল্লিখিত তাফসীরটিও তাফসীরে কাশ্শাফ এর সারাংশের ব্যাখ্যা।
এছাড়া পরবর্তী তাফসীর বিররায় এর যেকোন তাফসীর যেমন-
৮. তাফসীরে রুহুল মা‘আনী লিল আ-লূসী।
৯. মাহাসিনুত্তাবীল লিল-কাসেমী।
১০. আল-মানার লি-রশীদ রেযা।
১১. আত-তাহরীর ওয়াততানবীর লিইবনে আসূর। অর্থাৎ পরবর্তী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত, মুু‘তাযিলা বা শিয়া যেকোন দলের তাফসীরই হোক সেটার উৎস তাফসীরে কাশ্শাফ।
আল্লামা যামাখশারীর রহ. এর তাফসীর পদ্ধতিঃ
কুরআন কারীমের শাব্দিক বোধগম্য অর্থ গ্রহণ করাঃ
যামাখশারী রহ. লুগাতে আরবীর সহযোগিতায় কুরআন এর তাফসীর করতেন এবং লুগাতে আরবের মাধ্যমে কুরআনী আলফাযের অর্থ গ্রহণ করতেন। কারণ কুরআন কারীম অবতীর্ণ হয়েছে আরবী ভাষায় সুতরাং কুরআন কারীমের আলফায এর ব্যাখ্যার ব্যাপারে ও কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে আরবী ভাষার নিয়ম-নীতির ব্যতিক্রম জায়েয নেই। যেমন- بسم الله الرحمن الرحيم এর মাঝে ‘ইসমুন’ ‘আল্লাহ’ ‘আর-রাহমান’ ‘আর-রহীম’ শব্দগুলোর তাফসীর করা হয়েছে আরবী ভাষার নিয়ম অনুসারে।
কুরআন কারীমের বিন্যাসরীতির সৌন্দর্য বর্ণনা করা এবং বিন্যাসরীতির বর্ণনার বিশ্লেষণ করাঃ
কুরআন কারীমের তাফসীরের মাঝে যামাখশারী রহ. এর কর্ম পদ্ধতির নিয়ম-নীতি হল-কুরআনী বর্ণনাভঙ্গিকে অলংকার শাস্ত্রের আলোকে বিশ্লেষণ করা। কুরআন কারীম থেকে সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম চমৎকার বিষয়গুলো উদঘাটন করা। যেমন- وَقَالُوا لَوْلَا أُنْزِلَ عَلَيْهِ مَلَكٌ وَلَوْ أَنْزَلْنَا مَلَكًا لَقُضِيَ الْأَمْرُ ثُمَّ لَا يُنْظَرُونَ (৮)
এ আয়াতের তাফসীরে যামাখশারী রহ. কুরআন কারীমের বর্ণনা ভঙ্গির বিশ্লেষণ অলংকার শাস্ত্রের আলোকে করেছেন। যেমন:
ومعنى { ثُمَّ } بعد ما بين الأمرين : قضاء الأمر ، وعدم الإنظار . جعل عدم الإنظار أشدّ من قضاء الأمر ، لأنّ مفاجأة الشدّة أشدّ من نفس الشدّة
কুরআন কারীমের শব্দ বা বাক্যের অর্থ স্পষ্ট করতে প্রমাণসরূপ আরবী কাব্যসমূহ উদ্ধৃত করাঃ
আল্লামা যামাখশারী রহ. নিজের তাফসীরের মাঝে আরবী কাব্য দ্বারা উদ্ধৃতি পেশ করার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি আরবী শব্দের অর্থ বা বাক্যের ব্যাখ্যার ব্যাপারে আরবী কবিতা উদ্ধৃত করেন। এর জন্য প্রথমে তিনি কাব্যিকতাকে নিজের সহায়ক হিসেবে গ্রহণ করেন। কারণ তিনি অন্য বিভিন্ন শাস্ত্রের পাশাপাশি একজন কাব্য রচনাকারীও ছিলেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে কাব্যিক সংস্কৃতি তার সহায়ক হওয়ার কারণ হলো, তিনি জাহেলী ও ইসলামী যুগের অনেক আরবী কবিতাসমূহ মুখস্থ করেছেন। তিনি কবিতা দ্বারা এত বেশি উদ্ধৃতি উপস্থাপন করেছেন যে, কোন কোন স্থানে ৩ এর অধিক কবিতা দ্বারাও উদ্ধৃতি পেশ করেছেন।
তাফসীর বিল মা‘ছূর অনেক কম উল্লেখ করাঃ
তিনি কুরআন এর এক আয়াত দ্বারা অন্য আয়াতের তাফসীর খুব কম করেছেন। যখন তাফসীরের মাঝে কোন আয়াত উল্লেখ করেন তখন উক্ত আয়াতকে তাফসীর বিল মা‘ছূর হিসেবে নয়; বরং কুরআন কারীমের শাব্দিক অর্থ স্পষ্ট করা বা কুরআন কারীমের কোন বাক্য বিশ্লেষণ করা অথবা ইলমুল বালাগাহর কোন নিয়ম বর্ণনা করার জন্য নিয়ে আসেন। যেমন- وَأُشْرِبُوا فِي قُلُوبِهِمُ الْعِجْلَ بِكُفْرِهِمْ قُلْ بِئْسَمَا يَأْمُرُكُمْ بِهِ إِيمَانُكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (سورة البقرة-৯৩) এ আয়াতের মাঝে فِي قُلُوبِهِمُ এর ব্যাপারে বলেছেন যে, এটা হল وَأُشْرِبُوا এর স্থান। এ কথার দলীল পেশ করেছেন إِنَّ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ أَمْوَالَ الْيَتَامَى ظُلْمًا إِنَّمَا يَأْكُلُونَ فِي بُطُونِهِمْ نَارًا এ আয়াত দ্বারা। তাফসীর বিল মা‘ছুর এর লেখকগণ এর মত এক আয়াতের তাফসীর অন্য আয়াত দ্বারা করার জন্য খুব কমই কোন আয়াত উল্লেখ করেন।
তাফসীরুল কুরআন বিস্সুন্নাহঃ
তিনি হাদীসের আলেম না হওয়া সত্ত্বেও কখনো হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বারা কুরআন কারীমের তাফসীর করেছেন। এ জন্য তারঁ তাফসীরের মাঝে অনেক যয়ীফ, মওযূ হাদীস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অনেক সহীহ হাদীসও রয়েছে। ইমাম হাফেজ যায়লায়ী রহ. তাফসীরে কাশ্শাফে উল্লিখিত হাদীসগুলোকে তাখরীজ করেছেন আর তাঁর তাখরীজকে ইমাম হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. الكافي الشاف فى تخريج أحاديث الكشاف এর মাঝে সংক্ষিপ্ত করেছেন।
তাফসীরুল কুরআন বি-আকওয়ালিস্সাহাবাঃ
তিনি স্বীয় তাফসীরের মাঝে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীদের উক্তিসমূহের আলোকে কিছু তাফসীর করেছেন।
যেমন- نَبَذَ فَرِيقٌ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ كِتَابَ اللَّهِ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ كَأَنَّهُمْ لَا يَعْلَمُونَ (سورة البقرة:১০১) যামাখশারী রহ. এ আয়াতের তাফসীর করার সময় উল্লেখ করেন যে, হযরত শা‘বী রহ. উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন-তারা (কিতাবীরা) নিজেদের মাঝে আল্লাহ তা‘আলার কিতাব পাঠ করত এবং তারা এর প্রতি আমল করাকে প্রত্যাখ্যান করত।
আর হযরত সুফিয়ান রহ. উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন-তারা আল্লাহ তা‘আলার কালামকে রেশমী কাপড়ের মাঝে রাখত এবং স্বর্ণ দ্বারা সজ্জিত করত কিন্তু আল্লাহর কিতাবের হালালকে হালাল আর হারামকে হারাম মনে করত না।
তাফসীর বিদ-দিরায়াহঃ
তিনি তাফসীরের ক্ষেত্রে তাফসীর বিদ দিরায়া এর পদ্ধতিই অধিক লক্ষ্য করেছেন। তাফসীর বিল মা‘ছূরে বর্ণিত ইসরাঈলী বর্ণনার মত ইসরাঈলী রিওয়ায়াত আলোচনায় ডুবে যাননি এবং নবীদের ঘটনাবলীর সাথে সংশ্লিষ্ট ভুল রিওয়ায়াতগুলোও অনেক আলোচনা করেননি। এটা তাফসীরে কাশ্শাফ এর উল্লেখযোগ্য এক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এর অর্থ এই না যে, তাফসীরে কাশ্শাফ একেবারেই ইসরাঈলিয়্যাত মুক্ত বরং তাফসীরে কাশ্শাফ এর মাঝেও কিছু ইসরাঈলিয়্যাত বর্ণিত হয়েছে তবে সে বর্ণনাগুলো অন্যান্য তাফসীরের সাথে তুলনা করলে একেবারেই সামান্য।
মু‘তাযিলী মাযহাবের পাঁচ মূলনীতির আলোকে কুরআন কারীমের তাফসীরঃ
যামাখশারী রহ. এর তাফসীরের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্য হল মু‘তাযিলী মাযহাবের সাহায্য করা, কুরআন কারীমের আয়াত দ্বারা মু‘তাযিলী মাযহাবের জন্য উদ্ধৃতি উপস্থাপন করা, মু‘তাযিলী মাযহাব বিরোধী বিশেষ করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর উক্তিসমূহ খন্ডন করা। একারনেই তাফসীরের ক্ষেত্রে যামাখশারীর পন্থা হল মু‘তাযিলী মাযহাবের মূলনীতির আলোকে কুরআন কারীমের তাফসীর করা। যেমন: وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ (২২) إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ
(سورة القيامة:২২-২৩) এ আয়াতের ব্যাখ্যাকালে মুমিনদের জন্য পরকালে আল্লাহ তা‘আলার দর্শন খন্ডন করে বলেন যে, মুমিনগন কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তা‘আলাকে দেখার আশা করবে। দেখতে পারবে না।
(সূত্র. তা‘রীফুদ্দারিসীন বি-মানাহিজিল মুফাসসিরীন। কৃত: ড. সালাহ আব্দুল ফাত্তাহ আল-খালেদী)
মু‘তাযিলী মাযহাবের পাঁচ মূলনীতিঃ
মু‘তাযিলী মাযহাবের মুলনীতি পাঁচটি যথা: ১. তাওহীদ। ২. আদল। ৩. ওয়াদা ও ওয়ীদ। ৪. মানযিলাতুন বাইনা মানযিলাতাইন। ৫. আমর বিল মা‘রূফ ও নাহী আনিল মুনকার।
যামাখশারী রহ. এই মু‘তাযিলী পাঁচ মূলনীতির আলোকে তাফসীর করেছেন।
(সূত্র. তা‘রীফুদ্দারিসীন বিমানাহিজিল মুফাসসিরীন। কৃত: ড. সালাহ আব্দুল ফাত্তাহ আল-খালেদী)
মতামত দিন
আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।