বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত যতগুলো তাফসীর গ্রন্থ সংকলিত বা অনূদিত হয়েছে এসবের মধ্যে সর্ববৃহৎ গ্রন্থটির নাম ‘তাফসীরে নূরুল কুরআন’। এটি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এ তাফসীর গ্রন্থটি সংকলন করেছেন, বরেণ্য আলিমে দ্বীন, প্রতিথযশা লেখক ও গবেষক হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম রহ.। তিনি ১৯৩২ সনে কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানাধীন বাঘমারা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে
বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত যতগুলো তাফসীর গ্রন্থ সংকলিত বা অনূদিত হয়েছে এসবের মধ্যে সর্ববৃহৎ গ্রন্থটির নাম ‘তাফসীরে নূরুল কুরআন’। এটি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এ তাফসীর গ্রন্থটি সংকলন করেছেন, বরেণ্য আলিমে দ্বীন, প্রতিথযশা লেখক ও গবেষক হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম রহ.।
তিনি ১৯৩২ সনে কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানাধীন বাঘমারা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। স্থানীয় রহমতগঞ্জ মাদরসায়ই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়। এরপর ঢাকার হোসাইনিয়া আশরাফুল উলূম বড় কাটারা মাদরাসা ও নোয়াখালীর ইসলামিয়া মাদরাসায় ইলমে দ্বীন অর্জন করেন এবং সর্বশেষ মাদরাসা-ই-আলীয়া ঢাকা হতে ১৯৫৫ সনে কৃতিত্বের সাথে কামিল পাশ করেন।
উল্লেখ্য যে, কামিল পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় তিনি পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। এরপর আরো দু’বৎসর হাদীস শাস্ত্রে গবেষণা করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপন করার সাথে সাথে তিনি কুরআনী খিদমাত ও দ্বীন প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন এবং অল্প সময়েই দেশে-বিদেশে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন । রেডিও-টেলিভিশনে পবিত্র কুরআন উপস্থাপন ও দ্বীনী প্রোগ্রামে অংশ গ্রহণ করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরই সাথে ঢাকার বিভিন্ন মসজিদে তাফসীরুল কুরআনের দরস দিয়ে মুফাসসিরে কুরআন হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি সুদীর্ঘ ত্রিশ বৎসর ঐতিহাসিক লালবাগ শাহী মসজিদে খতীবের দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলা,উর্দূ , আরবী ও ইংরেজীতে বিশেষ পারদর্শী মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম লেখার ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রেখেছেন। তাফসীরে নূরুল কুরআন ব্যতিত তাঁর লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশটি। এসবের মধ্যে ‘বিশ্ব সভ্যতায় আল-কুরআনের অবদান’ নামক গ্রন্থটি তিনটি জাতীয় পুরস্কার লাভে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য গ্রন্থগুলোও পাঠক মহলে বিশেষ সমাদৃতি অর্জন করেছে।
উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন ধরনের দ্বীনী খিদমাত আঞ্জাম দানের পর কুরআনের এ মহান সাধক ১৯ নভেম্বর ২০০৭ এ পরম করুণাময়ের সান্নিধ্যে গমন করেন। ঐতিহাসিক লালবাগ শাহী মসজিদের সম্মুখস্থ কবরস্তানে আওলাদে রাসূল সা. হযরত মাওলানা মোস্তফা আল মাদানী রহ. ও অন্যান্য বুযুর্গানে দ্বীনের সাথে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলা ভাষার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ তাফসীর গ্রন্থ ‘তাফসীরে নূরুল কুরআন।’ ত্রিশ খন্ডে সমাপ্ত এ তাফসীর গ্রহন্থটিতে পূর্ণ কুরআনের তাফসীর স্থান পেয়েছে। ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় অধ্যায়নকালেই মাওলানা মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম নিজের মাঝে তাফসীর শাস্ত্রের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করেন। সে অনুযায়ী তিনি বিশেষভাবে এ বিষয়ে পড়াশুনা আরম্ভ করেন এবং ছাত্রাবস্থায়ই ১৯৫৪ ঈসায়ী থেকে ‘রেডিও পাকিস্তান’ ঢাকা কেন্দ্র হতে সম্প্রচারিত ‘কুরআনে হাকীম ও আমাদের জীবন’ প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে পবিত্র কুরআনের বিষয়ভিত্তিক তাফসীর আরম্ভ করেন। ছাত্র জীবন শেষ হলে পুরাতন ঢাকার বিভিন্ন মসজিদে দরসে তাফসীর এর মাধ্যমে নিজের কুরআনী তৃষ্ণা নিবারণে বিশেষভাবে প্রয়াসী হন। এভাবে কয়েক বৎসর অতিবাহিত হওয়ার পর বাংলা ভাষায় মৌলিক ও বিস্তারিত কোন তাফসীর গ্রন্থ না থাকার বিষয়টি তিনি গভীরভাবে উপলদ্ধি করেন এবং এই শূন্যতা পুরণের জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী হন। ক্রমান্বয়ে তাঁর এ আগ্রহ কেবল বৃদ্ধিই পেতে থাকে। এরই মাঝে অতিবাহিত হয়ে যায় আরো কয়েক বৎসর। অবশেষে আল্লাহ পাকের উপর ভরসা করে ১৯৬৬ সনে একটি মৌলিক ও বিস্তারিত তাফসীর গ্রন্থ সংকলনের কাজ শুরু করেন। তবে বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে নিয়মিত এ কাজটি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তারপরও তিনি হাল ছাড়েননি; বরং অনিয়মিতভাবে হলেও তিনি এ মহান খিদমাতটি আঞ্জাম দিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৬৬ সন থেকে অনিয়মিতভাবে তাঁর তাফসীর সংকলনের এ কাজ চলতে থাকে ১৯৮১ পর্যন্ত। এরপর ১৯৮১ সনে তিনি পবিত্র হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা-মদীনা গমন করে দু‘আ কবূলের স্থানগুলোতে তাফসীরে নূরুল কুরআনের জন্য বিশেষভাবে দু‘আ করেন। এভাবে দু‘আ ও যিয়ারত সম্পন্ন করে দেশে ফিরে এসে নিয়মিত ও নিরলসভাবে তাফসীর সংকলনের কাজ শুরু করেন। দীর্ঘ আঠার বৎসর অবিরামগতিতে সাধনা ও মুজাহাদার পর ১৯৯৮ সনে তাফসীরে নুরুল কুরআনের লিখন কার্য সম্পন্ন হয়।
তাফসীরে নূরুল কুরআনের বৈশিষ্ট্য
এ তাফসীর গ্রন্থটিতে প্রথমত নির্দিষ্ট সংখ্যক আয়াত উল্লেখ করার পর সেগুলোর তরজমা ও অনুবাদ লেখা হয়েছে। আর অনুবাদ হচ্ছে সরল, সাবলীল ও বোধগম্য ভাষায় লিখিত একটি মৌলিক ও স্বাতন্ত্র অনুবাদ। এ অনুবাদ কর্মটি চলিত ভাষায় সম্পাদিত হলেও এতে ভাষার গাম্ভির্যতা সম্পূর্ণ বহাল রয়েছে।
তরজমার পর ধারাবাহিকভাবে ও সুবিন্যস্ত আকারে তাফসীর সংক্রান্ত বিষয়গুলো সংকলন করা হয়েছে এবং আলোচনা পাঠকবর্গের নিকট অধিক সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামের আওতায় বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। তাফসীরুল কুরআন, মাসায়িলুল কুরআন ও আ‘মালুল কুরআন, এ তিনটি মৌলিক শিরোনাম ছাড়াও তাফসীরুল কুরআন মূল শিরোনামের আওতায় আরো বিভিন্ন উপ-শিরোনাম উল্লেখপূর্বক বিষয়গুলো বর্ণনা করা হয়েছে।
তাফসীরুল কুরআন
এ শিরোনামের আওতায় প্রয়োজনীয় যাবতীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকলেও সাধারণ পাঠকবর্গের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় তাত্ত্বিক আলোচনা যেমন, শব্দের গভীর বিশ্লেষণ, অলংকার শাস্ত্রের সুক্ষ্ম বিষয়াদি ও ক্বিরাআত শাস্ত্রের জটিল বিষয়গুলো সচেতনতার সাথে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এ শিরোনামের অধীনে বিভিন্ন উপ-শিরোনামের আওতায় বর্ণিত বিষয়গুলো নিম্নরূপ,
এক. সূরাহ্র প্রাসঙ্গিক আলোচনা : যথা: সূরাহ্র অবতরণ স্থান ও কাল,রুকু, আয়াত, বাক্য, শব্দ ও অক্ষরের সংখ্যা বর্ণনা। সূরাহ্র নামকরণ ও এর প্রেক্ষিত আলোচনা এবং সূরাহ্র একাধিক নামের বর্ণনা।
দুই. রবত বা যোগসূত্র বর্ণনা : প্রত্যেক সূরাহ্র শুরুতেই পূর্ববর্তী সূরাহ্র সাথে এর যোগসূত্র বর্ণনা করা হয়েছে। তেমনিভাবে সূরাহ্ অন্তর্ভুক্ত আয়াতসমূহের পারস্পরিক যোগসূত্রও উল্লেখ করা হয়েছে।
তিন. শানে নুযূল আলোচনা : শানে নুযূল সম্বলিত আয়াতগুলোর শানে নুযূল মুহাদ্দিছ ও মুফাসসিরগণের উদ্ধৃতিসহ উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে একাধিক বর্ণনা ও মত উল্লেখ করার ফলে এ শিরোনামের আওতায় শানে নুযূল বহির্ভূত বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে।
চার. সারাংশ বর্ণনা: নির্দিষ্ট সূরাহ অথবা নির্দিষ্ট সংখ্যক আয়াতের বিস্তারিত তাফসীর পেশ করার পূর্বে এর সার-সংক্ষেপ বর্ণনা করা হয়েছে।
পাঁচ. শব্দ ও বাক্যের ব্যাখ্যা : সাধারণ পাঠকদের জন্য উপযোগীতা বিবেচনা করে বিভিন্ন শব্দ ও বাক্যের ব্যাখ্যা পৃথকভাবে পেশ করা হয়েছে।
ছয়. গুণবাচক বিষয়গুলো বিশ্লেষণ : মূল আলোচনার শেষে আলোচনার সাথে সংশ্লিষ্ট আল্লাহ পাকের গুণবাচক নাম উল্লেখ করার হিকমাত বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
সাত. আধুনিক বিষয়াদির বিশ্লেষণ : আয়াত থেকে উৎসারিত রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতিসহ আধুনিক যুগের বিভিন্ন বিষয়ের যথার্থ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
আট. সংশয় নিরসন : আল-কুরআন সকল প্রকার সন্দেহের উর্ধ্বে হওয়ার ঘোষণা এ কিতাবের শুরুতেই দেওয়া হয়েছে। তারপরও আমাদের জ্ঞানের সীমাদ্ধতার দরুণ কোন কোন আয়াতের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হয়। তেমনিভাবে কুরআন বিদ্বেষীরা মানুষকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে কুরআনের আয়াত সম্পর্কে অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালায়। তাফসীর গ্রন্থটিতে কোন আয়াত সম্পর্কে সৃষ্ট সন্দেহের নিরসন অত্যন্ত সুন্দরভাবে করা হয়েছে।
নয়. ঘটনা ও ইতিহাস সম্পর্কৃত পর্যালোচনা : পবিত্র কুরআনে প্রয়োজন ও অবস্থার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন জাতি, গোত্র তাদের আবাসস্থল ও বিভিন্ন ভৌগলিক স্থানের উল্লেখ রয়েছে। এ তাফসীর গ্রন্থটিতে ক্ষেত্র বিশেষে এসব বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে।
মাসায়িলুল কুরআন :
উক্ত শিরোনামের আওতায় আয়াত সংশ্লিষ্ট মাসআলা-মাসায়িল আলোচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে হানাফী মাযহাবের প্রণিধানযোগ্য মাসআলা বর্ণনার পাশাপাশি ক্ষেত্র বিশেষে অন্যান্য ইমামগণের অভিমতও উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, তাফসীর সংকলন কার্য শেষ করা সম্ভব হয় কিনা এরূপ আশংকায় মাসায়িল বর্ণনার এ ধারাবাহিকতা শেষ পর্যন্ত সমানভাবে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
আ‘মালুল কুরআন :
এ শিরোনামের আওতায় নিজের অভিজ্ঞতা ও আকাবিরদের শিক্ষা থেকে বিভিন্ন সূরাহ্ ও আয়াত বিশেষের আমল ও এর উপকারিতা বর্ণনা করা হয়েছে।
এ তাফসীর সংকলনের ক্ষেত্রে ‘উসূলুত্ তাফসীর’ এর নীতিমালার যথাযথ অনুসরণে এবং সলফে সালিহীন এর তাফসীর সংকলন পদ্ধতি অবলম্বনে এ গ্রন্থটি সংকলিত হয়েছে।
সালাফে সালিহীন এর কিতাব হতে বিভিন্ন আয়াতের তাফসীর সংকলন করার পর যথাযথস্থানে উদ্ধৃতি পেশ করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে উদ্ধৃত বিষয়ের হুবহু বর্ণনা না করে ভাবার্থ গ্রহণ করা হয়েছে। মোটকথা, সার্বিক বিবেচনায় আমাদের এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে যে, যদিও এ গ্রন্থটি ত্রুটি-বিচ্যুতির উর্ধ্বে নয়; কিন্তু তারপরও এটা যে অত্যন্ত মূল্যবান একটি সম্পদ, এতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহ্ এ তাফসীর গ্রন্থটিকে কবূল করুন। আমাদেরকে এর দ্বারা উপকৃত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আর সংকলককে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন ॥
মতামত দিন
আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।