লেখক পরিচিতি: নাম ও বংশ: মুহাম্মদ রশীদ বিন আলী বিন রেযা বিন মুহাম্মদ শামসুদ্দীন বিন সায়্যিদ বাহাউদ্দীন। তবে তিনি স্বীয় দাদা রেযা এর নামের দিকে নিসবাত করে রশীদ রেযা নামেই পরিচিত। জন্ম: তিনি ১২৮২ হিজরীর ২৭ জুমাদাল উলা বুধবার ‘শাম’ এর দক্ষিণ অঞ্চলের ‘কালমুন’ এলাকায় জন্ম লাভ করেন। শিক্ষা: তিনি শামের ‘মাদরাসাতুল ওতানিয়্যা ইসলামিয়া’ তে
লেখক পরিচিতি:
নাম ও বংশ: মুহাম্মদ রশীদ বিন আলী বিন রেযা বিন মুহাম্মদ শামসুদ্দীন বিন সায়্যিদ বাহাউদ্দীন। তবে তিনি স্বীয় দাদা রেযা এর নামের দিকে নিসবাত করে রশীদ রেযা নামেই পরিচিত।
জন্ম: তিনি ১২৮২ হিজরীর ২৭ জুমাদাল উলা বুধবার ‘শাম’ এর দক্ষিণ অঞ্চলের ‘কালমুন’ এলাকায় জন্ম লাভ করেন।
শিক্ষা: তিনি শামের ‘মাদরাসাতুল ওতানিয়্যা ইসলামিয়া’ তে দাখেলা নেন। এবং পরবর্তীতে মাদরাসায়ে দ্বীনিয়ায় ভর্তি হয়ে ‘আন্তর্জাতিক শাহাদাহ’ অর্জন করেন। সায়্যিদ রশীদ রেযা ইমাম গাযালী রহ. এর ‘ইয়াহইয়ায়ে উলূমুদ্দীন’ ও ‘আল উরওয়াতুল উসকা’ এবং জামালুদ্দীন আফগানী এবং শায়খ মুহাম্মদ আবদুহু দ্বারা অনেক প্রভাবিত হয়েছেন।
রচনা: সায়্যিদ মুহাম্মদ রশীদ রেযা বিভিন্ন বিষয়ের অনেক রচনা করেন। সেগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য কিছু-
১- الوحي المحمدي ২. مناسك الحج. ৩. تفسير الفاتحة وست سور من خواتيم القرآن. ৪.ترجمة القرآن. ৫. فتاوى السيد رشيد رضا.
ওফাত: সায়্যিদ রশীদ রেযা ১৩৫৪ হিজরীর ২৩ জুমাদাল উলা বৃহ:বার কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। তাকে তাঁর উস্তাদ শায়খ মুহাম্মদ আব্দুহু এর পাশে সমাহিত করা হয়েছে।
তাফসীর পরিচিতি:
এ তাফসীরটির মূল ভিত্তি হল শায়খ মুহাম্মদ আব্দুহু কর্তৃক কিছু দরসের সমষ্টি। যা তিনি স্বীয় শাগরেদ সায়্যিদ মুহাম্মদ রশীদ রেযার প্রস্তাবে ১৩১৭ হিজরীর মুহাররম মাসের শুরুলগ্নে শুরু করেছিলেন। এ দরসগুলো ১৩২৩ হিজরী পর্যন্ত অব্যাহত থাকে এবং সূরা নিসার ১২৫ নং আয়াতে এসে থেমে যায়। দরসের পাঠসমূহ সায়্যিদ মুহাম্মদ রশীদ রেযা লিপিবদ্ধ করে তার নিজ পত্রিক ‘আল-মানার’ এ প্রকাশিত করতে থাকেন। এজন্যই তাফসীরের এ গ্রন্থটিকে ‘তাফসীরে মানার’ নামকরণ করা হয়। অন্যথায় তাফসীরের এ গ্রন্থটির মূল নাম হল- ‘তাফসীরুল কুরআনিল হাকীম’। শায়খ মুহাম্মদ আবদুহুর তিরোধানের পর সায়্যিদ মুহাম্মদ রশীদ রেযা তাফসীরের অবশিষ্টাংশ নিজে লিখে পূর্ণ করেছেন। তবে তিনি স্বীয় উস্তাদের নিয়ম-নীতি কিছুটা পরিবর্তন করে অনেকটা উসূলে তাফসীরের কাছাকাছি পৌঁছেছেন। সায়্যিদ মুহাম্মদ রশীদ রেযা সূরা নিসার ১২৫ নং আয়াত থেকে সূরা ইউসূফের ১০১ নং আয়াতের তাফসীর করে ইহধাম ত্যাগ করেন। অতপর সূরা ইউসূফের বাকি অংশের তাফসীর সম্পন্ন করেন সায়্যিদ রশীদ রেযার এক শাগরেদ (محمد بهجة البيطار)।
শায়েখ মুহাম্মদ আবদুহু্র তাফসীরী চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য:
১. কুরআন কারীমকে বিশেষ কোন ফিক্বহী মাযহাবের আলোকে বিবেচনা করা হয়নি। যেমনটি অতীতের অধিকাংশ মুফাসসির কুরআন কারীমকে বিশেষ কোন ইমামের মুকাল্লিদ হওয়া হিসাবে চিন্তা করেছেন। এর দ্বারা বুঝা যায় যে কুরআন কারীম যেন কোন ফিক্বহী মাসলাক অনুযায়ী রচিত এবং কুরআন কারীমের আসল অর্থ বাদ দিয়ে পেঁচিয়ে সে বিশেষ ইমামের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মিলানোর চেষ্টা করা হয় যদিও তা কৃত্রিমতার উপর নির্ভরশীল ও কিয়াস বহির্ভূত।
২. এ তাফসীরী পাঠশালার ধারক বাহকগন ইসরাঈলী রিওয়ায়াতগুলো হুবহু গ্রহণ করেননি। বরং নিরীক্ষকের দৃষ্টি দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। অথচ অতীত মুফাসসিরদের তাফসীর গ্রন্থসমূহ ইসরাঈলী রিওয়ায়াতের ভান্ডার ছিল যাতে সত্য মিথ্যার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হত না। ফলে কুরআন কারীমের মাহাত্ম ও সৌন্দর্য অবশিষ্ট থাকেনি, সাথে সাথে অভিযোগকারীদের কুরআন কারীমকে সমালোচনার লক্ষ্য বানানোর সুযোগ হয়েছে ।
৩. জয়ীফ ও বানোয়াট হাদীস থেকে নিজেদের তাফসীর মুক্ত রেখেছেন। অন্যদিকে অন্যান্য মুফাসসিরগন উদার মনে এ জয়ীফ হাদীস গ্রহণ করেছেন এবং এর দ্বারা তাদের তাফসীর গ্রন্থসমূহ মন্দভাবে প্রভাবিত হয়েছে।
৪. ইসরাঈলী রিওয়ায়াত ও বানোয়াট হাদীস বাদ দেয়ার কারণে কুরআন কারীমের অস্পষ্ট বিষয়গুলো অস্পষ্ট রেখেছেন। এমনিভাবে অদৃশ্যের যে বিষয়গুলো শরয়ী নুসূস বিহীন জানা সম্ভব না সেগুলোতে মনোনিবেশ করার সাহস দেখাননি। তবে সে বিষয়গুলোতে ইজমালী ঈমানই যথেষ্ট, বিশ্লেষণ জরুরী না।
৫. শায়েখ মুহাম্মদ আব্দুহু এর চিন্তা-চেতনা, উলূম ও ফূনূনের সে পরিভাষাসমূহ থেকে পরিপূর্ণ মুক্ত যেগুলোকে প্রয়োজন ছাড়াই তাফসীরের কিতাবসমূহে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। যদি কোথাও সে পরিভাষাসমূহের উল্লেখ হয়ে থাকে তাহলে তা অত্যন্ত প্রয়োজনের ভিত্তিতে হয়েছে।
৬. সাহিত্যিক ও শিক্ষামূলক পদ্ধতী গ্রহণ করা হয়েছে। কুরআন কারীমের ইলমে বালাগাত ও ই‘জায তথা মু‘জিযার আবরণ খুলে দিয়েছেন। কুরআন কারীমের অর্থ ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
৭. কুরআন কারীমের মাঝে স্বভাবগত যে মূলনীতি ও কানূন বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিয়েছেন। কুরআনী শিক্ষার আলোকে মুসলিম উম্মাহ ও সাধারণ মানুষের সমস্যাবলীর সমাধান দিয়েছেন। কুরআন কারীম ও আধুনিক জ্ঞানের সহীহ দৃষ্টি ভঙ্গির মাঝে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। তাদের প্রচেষ্টায় মানুষের নিকট এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে, কুরআন কারীম এমন চিরন্তন গ্রন্থ যা কিয়ামাত পর্যন্ত প্রত্যেক যুগের সাথে ফিট হবে।
৮. কুরআন কারীমকে যে সকল সন্দেহের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছিল সেগুলোর দাঁত ভাঙ্গা জওয়াব দিয়েছেন। সাথে সাথে তাদের তাফসীরে এমন আকর্ষণীয় আদবী উসলূব অনুস্মরণ করা হয়েছে যেগুলোর কারণে পাঠক প্রভাবিত না হয়ে পারবে না।
৯. এ চৌম্বিক আকর্ষণ পদ্ধতীর তাফসীরের কারণে মানুষ কুরআন কারীমের সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বিষয় জানার প্রতি অতি আগ্রহী হয়েছে
শায়েখ মুহাম্মদ আবদুহু-এর তাফসীরী চিন্তাধারার ত্রুটি:
শাইখ মুহাম্মদ আবদুহু এর তাফসীরী চিন্তা-চেতনার উল্লিখিত গুনাবলী ও প্রশংসা সত্তেও এর উল্লেখযোগ্য কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে।
১. সবচেয়ে বড় ত্রুটি হল তিনি মানুষের আকলকে লাগামহীন করেছেন। ফলে কুরআন কারীমের অনেক হাকীকত এর ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছাড়াই তাবীল এর আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন হাকীকত এর পরিবর্তে রূপক অর্থ উদ্দেশ্য নিয়েছেন। মানুষের বাধ্যবাধকতা ও অপারগতার কারণে অনেক বিষয় কে বিশ^য়ের দৃষ্টিতে দেখেছেন। অথচ সেগুলোর প্রতি সে ব্যক্তিই আশ্চার্যান্বিত হতে পারে যে আল্লাহ তা‘আলার কুদরত সম্পর্কে অজ্ঞ।
২. শাইখ মুহাম্মদ আবদুহুর তাফসীরী পাঠশালার মুক্ত চিন্তা-চেতনা অনেকটা মু‘তাযিলাদের সাথে মিলে যায়। যেমন তারা কুরআন কারীমের কিছু শব্দাবলীর এমন অর্থ ও উদ্দেশ্য গ্রহণ করেছেন যা কুরআন কারীম অবতরণকালে আরবদের মাঝে পরিচিত ছিল না। এমনকি তারা বুখারী-মুসলিম শরীফের সহীহ হাদীসকে যয়ীফ ও মওযূও বলেছেন। অথচ আহলে ইলমের ইজমা‘ দ্বারা প্রমানিত যে এ দুই কিতাব أصح الكتب بعد كتاب الله
৩. সহীহ ও প্রমানিত হাদীসে আ-হা-দকে আক্বীদার অধ্যায়ে মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন। অথচ আক্বায়িদের অধ্যায়ে অসংখ্য হাদীসে আ-হা-দ বর্ণিত হয়েছে।
৪. ‘খবরে ওয়াহেদ’ দ্বারা আক্বায়িদের ক্ষেত্রে দলীল না হওয়ার ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের ইজমা বর্ণনা করেছেন। তাদের এ দাবী কয়েকটি কারণে ভুল-
৫. আকায়িদের ব্যাপারে খবরে ওয়াহেদের দ্বারা দলীল গ্রহণযোগ্য না হওয়ার যে ইজমায়ে উলামার দাবী তিনি করেছেন তা সঠিক নয়। কারণ খবরে ওয়াহেদ ইলমে ইয়াক্বীন এর ফায়েদা দেওয়া না দেওয়ার ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের চারটি মত উল্লেখ রয়েছে-১. খবরে ওয়াহেদ علم ظن এর ফায়েদা দেয়।
৬. ২. কারিনা পাওয়া গেলে ইলমে ইয়াক্বীনের ফায়েদা দেয়। ৩. কিয়াসের মুওয়াফিক হলে কারীনা ছাড়াও ইলমে ইয়াক্বীন এর ফায়েদা দেয়। ৪. কারীনা ও কিয়াসের মুওয়াফিক না হলেও ইলমে ইয়াক্বীনের ফায়েদা দেয়।
৭. যখন আমরা এ বিষয়টি মেনে নিয়েছি যে, খবরে ওয়াহেদ দ্বারা নিশ্চিত ও ইয়াক্বীনী ইলম হাসিল হয় তখন খবরে ওয়াহেদ দ্বারা আক্বায়িদ প্রমাণিত করা সম্ভব। যদি বলা হয় যে খবরে ওয়াহেদ দ্বারা ظنى ইলম হাসিল হয় তাহলেও কারীনা পাওয়া গেলে খবরে ওয়াহেদ দ্বারা ইলমে ইয়াক্বীন হাসিল হতে পারে। এজন্যই ইবনুস সালাহ ও অন্যান্য মুহাদ্দিসীন পুরা দৃঢ়তার সাথে এ কথা বলেছেন যে বুখারী-মুসলিম এর যে হাদীসগুলোতে জারাহ তা‘দীল করা হয়নি সেগুলো ইলমে ইয়াক্বীনের ফায়েদা দিবে। কারণ উম্মত সেগুলোকে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেছেন। আর মুসলিম উম্মাহ সমষ্টিগতভাবে ভুল-ভ্রান্তি মুক্ত। আর ভুল-ভ্রান্তি ম্ক্তুদের ধারনা বাظن ক্রটিযুক্ত নয়। (মুকাদ্দামা ইবনুস সালাহ:পৃ-১৪)
৮. আক্বায়িদ দ্বারা প্রত্যেক এমন জিনিস উদ্দেশ্য নয় যার বিশুদ্ধতা মেনে নেয়া হয়। কারণ আক্বায়িদ দ্বারা এমন জিনিস উদ্দেশ্য হলে ফিক্বহী আহকামকেও আক্বায়িদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ ফিক্বহী আহকাম মেনে নেওয়ার পূর্বে সেগুলোর বিশুদ্ধতাও মেনে নিতে হয়। অন্যথায় আমলেরই প্রয়োজন থাকতো না। আক্বায়িদ দ্বারা এমন উসূলে দ্বীন উদ্দেশ্য যেগুলো মেনে না নিলে কুফরী লাযেম আসে। যেমন আল্লাহ তা‘আলার যাত-সিফাত ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখা। অতিত ভবিষ্যতের ঘটনা সম্বলিত হাদীসসমূহ বা কিয়ামাতের বিশ্লেষণ সংক্রান্ত হাদীসসমূহের ব্যাপারে তাওয়াতুর এর শর্ত নেই; কারণ এ বিষয়গুলো আক্বায়িদ সংশ্লিষ্ট নয় যে সেগুলো না মানার দ্বারা কুফুরী লাযেম আসবে। এগুলোর ক্ষেত্রে শুধু এতটুকুই যথেষ্ট যে হাদীসগুলো সহীহ সনদে বর্ণিত।
-সূত্র-
তারীখে তাফসীর ওয়া মুফাসসিরীন-
ইত্তেজাহাতুত তাফসীর- ঃ খ-২, পৃ-৮০৮।
তাফসীরে মানার-: খ-১১, পৃ-১৫৫।
আল ওয়াহয়িল মুহাম্মাদী: পৃ-৬৬
আত তাফসীর ওয়াল মুফাসসিরুন: খ-২, পৃ-৫০৫-৫১৭।
মতামত দিন
আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।