বাংলা ভাষায় কুরআন তরজমা ও তাফসীর: একটি গবেষণামূলক পর্যালোচনা-1 পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে আরবী ভাষায়। তাই সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের ভাষায় অবতীর্ণ আল-কুরআনের অনেক আয়াতের অর্থ ও মর্ম অতি সহজেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। কোন আয়াতের মর্ম উদঘাটনে সমস্যার সম্মুখীন হলে রাসূলে আকরাম সা. এর নিকট জিজ্ঞাসা করে এর সমাধান করিয়ে নিয়েছেন। এভাবেই তাঁদের মাঝে আল-কুরআনের
বাংলা ভাষায়
কুরআন তরজমা ও তাফসীর:
একটি গবেষণামূলক পর্যালোচনা-1
পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে আরবী ভাষায়। তাই সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের ভাষায় অবতীর্ণ আল-কুরআনের অনেক আয়াতের অর্থ ও মর্ম অতি সহজেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। কোন আয়াতের মর্ম উদঘাটনে সমস্যার সম্মুখীন হলে রাসূলে আকরাম সা. এর নিকট জিজ্ঞাসা করে এর সমাধান করিয়ে নিয়েছেন।
এভাবেই তাঁদের মাঝে আল-কুরআনের চর্চা অব্যাহত থাকে। কিন্তু ইসলাম যখন আরব ভূখন্ড পেরিয়ে অনারবদের মাঝে প্রচারিত হতে শুরু করল এবং কুরআনের ভবিষ্যদ্বানী:وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا
“আর আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন।” (সূরা নাসর:২) অনুযায়ী মানুষ দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে লাগল, তখন তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষায় আল-কুআনের অনুবাদ করার প্রয়োজন দেখা দিল। সুতরাং এ প্রেক্ষিতে সাহাবায়ে কিরামের যুগ থেকেই অনারবী ভাষায় কুরআন কারীমের তরজমা বা অনুবাদ কার্যক্রম শুরু হয়ে গিয়েছিল।
শামসূল আয়িম্মা সারাখসী র. ‘আলমাবসূত’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, হযরত সালমান ফারসী রা. আরবী না জানা পারস্যের অধিবাসীদের জন্য. ফার্সী ভাষায় সূরা ফাতিহার তরজমা করেছিলেন। (আল-মাবসূত:খ-১,পৃ-৩৭)
হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রসিদ্ধ পর্যটক বায্রুক ইবনে শাহরিয়ার, তার ছফরনামা ‘আজায়িবুল হিন্দ’ এ কুরআন মাজিদের একটি তরজমার উল্লেখ করেছেন যে, কাশ্মিরের রাজা মেহরুকের ইশারায় হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর শেষভাগে হিন্দুস্তানী ভাষায় কুরআনের অনুবাদ করা হয়েছে।
বাযরুক ইবনে শাহরিয়ার লিখেন যে, কাশ্মিরের রাজা মেহরুক ২৭০ হিজরী মুতাবিক ৮৮৩ ইংরেজীতে মানসূরার শাসক আমীর আব্দুল্লাহ বিন উমর এর নিকট লিখে পাঠিয়েছেন যে, আমার নিকট এমন কাউকে প্রেরণ করুন যিনি ইসলামী শরীয়াতের বিধি-বিধান হিন্দী ভাষায় বর্ণনা করতে পারেন। আমীর আব্দুল্লাহ হিন্দুস্তানের বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী এক আলেমকে সেখানে প্রেরণ করলেন। তিনি রাজা মেহরূকের নিকট কয়েক বৎসর অবস্থান করে ইসলামের যাবতীয় বিষয়াদি সস্পর্কে তাকে অবহিত করলেন। এরপর রাজা সেই আলিমের নিকট নিজের জন্য হিন্দী ভাষায় কুরআন কারীমের তরজমা ও তাফসীর লিখে দেয়ার অনুরোধ করলেন । রাজার অনুরোধের প্রেক্ষিতে তিনি আল-কুরআনের তরজমা ও তাফসীর লেখা শুরু করেন এবং তখন সূরা ইয়াসীন পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছিল বলে জানা যায়।
মোটকথা, সাহাবায়ে কিরামের যুগে শুরু হওয়া ভিন্ন ভাষায় কুরআন তরজমার কাজ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। ফলে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ভাষায়ই আল-কুরআনের তরজমা ও তাফসীর গ্রন্থ সংকলন সম্পন্ন হয়। তবে এটা সত্য যে, শুরুর দিকে অন্য যে কোন ভাষার তুলনায় ফার্সী ভাষায়ই কুরআনের তরজমা ও তাফসীর অধিক সংকলিত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, এক কালে হিন্দুস্তানের ভাষাও ছিল ফার্সী। সুতরাং এখানের উলামায়ে কিরামও ফার্সী ভাষায় কুরআনী খিদমাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নিজাম নীসাপুরী হিসাবে প্রসিদ্ধ হাসান বিন মুহাম্মদ আলকামী (৭৩০হিজরী) কৃত তরজমাটি হিন্দুস্তানে ফার্সী ভাষার প্রথম তরজমা বলে ধারণা করা হয়। তবে এ তরজমাটি সাধারণের মাঝে তেমন সমাদৃত না হওয়ায় আল্লামা শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছে দেহলভী র. ‘ফাতহুর রহমান’ নামে নতুন আঙ্গিকে পবিত্র কুরআনের তরজমা ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর সংকলন করেন। হজরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ র. কৃত এ তাফসীর গ্রন্থটি এখনো এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
বাংলা ভাষায় কুরআন তরজমা ও কিছু কথা
১. বাংলা ভাষায় কুরআন কারীম থেকে সরাসরি কেউ অনুবাদ করেছেন কিনা এ ব্যাপারে কোন তথ্য আমার অনুসন্ধানে মিলেনি। বাংলা ভাষায় কুরআন কারীমের সবগুলো তরজমাই ভিন্ন কোন ভাষা থেকে সরাসরি অনূদিত হয়ে এসেছে বা কোন তরজমার আলোকে লিখিত হয়েছে। বিষয়টি কোন লেখক স্বীকার করেছেন আবার অনেকেই অস্পষ্ট রেখেছেন।
২. বাংলা ভাষার তরজমাগুলোর অধিকাংশের মূল উৎস হলো উর্দূ-ফারসী। আর দু’একটি তরজমার উৎস ইংরেজী। উর্দূ ভাষার তরজমাগুলোর মূল উৎস হলো বিশেষভাবে দু’টি তরজমা: ১. শাহ আব্দুল কাদির রহ. এর তরজমা ‘মুযিহুল কুরআন’। ২. শাহ রফীউদ্দীন রহ. এর তরজমা ‘শব্দে শব্দে তরজমা’। আর এ দু’টি তরজমার পূর্বে যেহেতু শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী রহ. এর ফারসী তরজমা ‘ফাতহুর রহমান’ সংকলিত হয়েছিল সেহিসেবে এ দু’টি তরজমার উৎস ‘ফাতহুর রহমান’ বলা চলে।
৩. শাহ আব্দুল কাদির রহ. এর মুযিহুল কুরআন ও শাহ রফীউদ্দীন রহ. এর ‘শব্দে শব্দে তরজমা’ এর পর তাফসীরে বয়ানুল কুরআন এর পূর্বে আরো চারটি উর্দূ তরজমার সন্ধান পাওয়া যায় এবং ‘তরজমায়ে শাইখুল হিন্দ বা তাফসীরে উসমানী’-র পূর্বে উর্দূ ভাষায় বয়ানুল কুরআন ছাড়া আরো ছয়টি তরজমার সন্ধান পাওয়া যায় এগুলোর কোনটিই উর্দূ ভাষার পরবর্তী কোন তরজমার এবং বাংলা ভাষার পরবর্তী কোন তরজমার উৎস হওয়ার বিষয়টি কোন লেখক উল্লেখ করেননি।
৪. বাংলা ভাষার দু’ একটি তরজমা ছাড়া প্রায় সবগুলো তরজমাতুল কুরআন এর মূল উৎস হলো ‘তাফসীরে বয়ানুল কুরআন’ বা ‘তাফসীরে উসমানী’ অথবা উভয় তাফসীরের তরজমার সমন্বয়ে বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে কুরআন কারীমের একটি অনুবাদ।
৫. বাংলা ভাষায় যারা কুরআন কারীমের অনুবাদ করার প্রয়াস পেয়েছেন তাদের দু’একজন ছাড়া অধিকাংশই তাদের অনুবাদের ‘উৎস’ স্পষ্ট করেননি। কিন্তু তাদের তরজমা পাঠে অনুমান করা যায় যে, অনূদিত তরজমাটি তাফসীরে বয়ানুল কুরআন বা তরজমায়ে শাইখুল হিন্দ অথবা উভয়টির আলোকে লিখিত।
যেমন-১. বঙ্গানুবাদ নূরানী কোরআন শরীফ’ অনুবাদক মাওলানা নুরুর রহমান। এটি তাফসীরে বয়ানুল কুরআন এর সংক্ষিপ্ত টীকা সম্বলিত তাফসীরে বয়ানুল কুরআন এর তরজমার সরাসরি একটি অনুবাদ।
২. ‘আলকুরআনুল কারীম’ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত। এ তরজমাটির মূল উৎস স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা না হলেও তরজমা পাঠে অনুমান করা যায় যে, এ তরজমাটির মূল উৎস ‘তাফসীরে উসমানী’।
৩. সরল রীতির তরজমা কৃত ড. ফজলুর রহমান। এ তরজমাটির মূল উৎস উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর তরজমা ও সরল রীতির তরজমা মিলিয়ে পাঠ করলে বোঝা যায় যে, সরল রীতির তরজমাটি মূলত ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর তরজমারই সংস্কৃত রূপ। তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর তরজমাতে কিছুটা ভাবার্থের দিকে লক্ষ্য করা হয়েছে।
বাংলা ভাষায় কুরআন কারীম অনুবাদে বিলম্বের কারণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশাতেই কুরআন অনুবাদের বীজ উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ইন্তেকালের দীর্ঘদিন পরেও তাঁর অনুসারীরা এ পথে অগ্রসর হননি। এর কারণ সম্ভবত এই-
১. তাঁরা এ কাজকে দুঃসাধ্য মনে করতেন। যেমন-কুরআনের বাংলা অনুবাদক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন: “কুরআন মাজীদের অনুবাদ যে ভাষাতেই হোক না কেন তা অসম্ভব। তবে অনুবাদে মূলের কিছুটা ছায়া দেয়া যেতে পারে।”
২. কুরআন অনুবাদের প্রতি মধ্যযুগে এমন কি আধুনিক যুগের গোড়ার দিকেও মুসলমানদের নিরাসক্তি ও অবহেলার আরো একটি কারণ এই ছিল যে, তাঁদের একটি রক্ষণশীল দল এ কাজকে অবৈধ বলে মনে করতেন। (বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা:২৩)
এছাড়া বাংলা ভাষায় কুরআন তরজমা ও তাফসীরের কাজ বিলম্বিত হওয়ার আরো একটি কারণ হলো-
৩. মধ্যযুগে বাঙ্গালী মুসলমানদের সরকারী ও সাংস্কৃতিক ভাষার বাহন ছিল ফার্সী ও উর্দূ। আর এ দু’ভাষায় কুরআন কারীমের প্রচুর তরজমা ও তাফসীর প্রকাশিত থাকায় বাংলা ভাষায় নতুন করে তরজমা করার প্রয়োজন অনুভূত হয়নি।
(বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা:পৃ-২৭)
কুরআন কারীমের প্রথম বাংলা অনুবাদক
পবিত্র কুরআন কারীমের সর্ব প্রথম আংশিক বাংলা অনুবাদক ছিলেন বাংলাদেশের রংপুর নিবাসী মৌলবী আমিরুদ্দীন বসুনিয়া। সেই অনুবাদের আংশিক মুদ্রিত কপি পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় পুর্ণাঙ্গ অনুবাদক ছিলেন টাঙ্গাইলের মৌলবী নঈমউদ্দীন। অমুসলিমদের মাঝে সর্বপ্রথম পুর্ণাঙ্গ ত্রিশ পারা কুরআন শরীফের বঙ্গানুবাদ করেন বাবু গিরিশ চন্দ্রসেন। (বঙ্গানুবাদ কুরআন শরীফ, অনুবাদ: মাওলানা মোবারক করীম জওহর) উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত তথ্যটি মাওলানা মোবারক করীম জওহর রহ. এর ব্যক্তিগত। কারণ সঠিক তথ্য কিছুটা এর ব্যতিক্রম।
বাংলা ভাষায় কুরআন কারীমের প্রথম পূর্ণাঙ্গ তরজমা
কুরআন কারীমের সর্ব প্রথম বাংলা ভাষায় পূর্ণাঙ্গ অনুবাদক এর কৃতিত্ব কোন একক ব্যাক্তির নয়; বরং এ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন মুসলিম সমাজের এক জামাত। তারা হলেন- “মজলিসে উলামা কলিকাতা”। (মা‘হাদু উলূমিল কুরআন এর স্বারক?)
বাংলা ভাষায় প্রথম কুরআন কারীমের আংশিক তরজমা
১. বাংলা ভাষায় কুরআন কারীমের তরজমার প্রথম পথিকৃৎ ছিলেন রংপুরের আমীরুদ্দীন বসুনিয়া। তিনি মুসলমানী বাংলা তথা পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় কুরআনের ত্রিশতম পারা বাংলা কাব্যানুবাদ করেন। তাঁর বইটির প্রকাশকালের সঠিক সন-তারিখ না জানা গেলেও মুদ্রণরীতির উপকরণের প্রাচীনত্ব ও বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে একে প্রাচীন বলেই মনে করা হয়। এর প্রমাণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, বইখানি পাথরের উপর কাঠের অক্ষরে ছাপা হয়েছিল। আমীরুদ্দীন বসুনিয়ার পরিচিতি সম্পর্কিত উপকরণাদি তেমন পাওয়া যায় না। তবে তিনি ছিলেন রংপুরের অন্তর্গত গংগাচড়া থানাধীন চিনাখাল মটুকপুর গ্রামের অধিবাসী। গ্রামটি এককালে রংপুরের শহরতলীতে কোলকন্দ ও গংগাচড়ের পরে তিস্তা নদের তীরে অবস্থিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটি তিস্তার অতল গর্ভে অন্তর্হিত। বসুনিয়া শব্দটি হচ্ছে রংপুরের আঞ্চলিক পরিভাষা। এর অর্থ গ্রাম্য-প্রধান। (বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা:৩৫
মতামত দিন
আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।