হিজরী প্রথম শতাব্দীর তাফসীর গ্রন্থসমূহ

হিজরী প্রথম শতাব্দীর তাফসীর গ্রন্থসমূহ
মাওলানা কামরুল ইসলাম সাহেব দামাত বারাকাতুহুমপ্রথম হিজরী শতাব্দী সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই অন্তত ৩ টি তাফসীর

হিজরী প্রথম শতাব্দীর তাফসীর গ্রন্থসমূহ: একথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, রাসূলে আকরাম সা. এর যুগে বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ সংকলনের তৎপরতা ছিল খুবই কম। আর প্রিয়নবী সা. এর জীবদ্দশায় গ্রন্থ সংকলনের প্রয়োজনও তেমন ছিল না। কারণ তখন পবিত্র কুরআনের তাফসীর বিষয়ে সাহাবায়ে কিরাম রা. কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে রাসূলে আকরাম সা. এর নিকট জিজ্ঞাসা করে এর সমাধান

হিজরী প্রথম শতাব্দীর তাফসীর গ্রন্থসমূহ:

একথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, রাসূলে আকরাম সা. এর যুগে বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ সংকলনের তৎপরতা ছিল খুবই কম। আর প্রিয়নবী সা. এর জীবদ্দশায় গ্রন্থ সংকলনের প্রয়োজনও তেমন ছিল না। কারণ তখন পবিত্র কুরআনের তাফসীর বিষয়ে সাহাবায়ে কিরাম রা. কোন সমস্যার সম্মুখীন হলে রাসূলে আকরাম সা. এর নিকট জিজ্ঞাসা করে এর সমাধান করিয়ে নিতেন। এছাড়া তখন সংকলন কম হওয়ার আরও নানাবিধ কারণ ছিল।

সংকলন কম হওয়ার নানাবিধ কারণ

১. লেখার উপকরণের অপ্রতুলতা।
২. রাসূলে আকরাম সা. ইরশাদ করেন:
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: (لا تَكْتُبُوا عَنِّي وَمَنْ كَتَبَ عَنِّي غَيْرَ الْقُرْآنِ فَلْيَمْحُهُ) رواه مسلم (الزهد والرقائق/৫৩২৬)
“আমার নিকট থেকে কুরআন ব্যতিত অন্য কিছু লিখো না। যে কুরআন ব্যতিত অন্য কিছু লেখে সে যেন তা মুছে ফেলে।” (সহীহ মুসলিম: ৫৩২৬)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উক্ত নির্দেশের প্রতি আনুগত্য প্রদান।
৩. আরবদের প্রখর মেধা ও স্মৃতিশক্তি।
৪. দা‘ওয়াত ও জিহাদী কার্যক্রমে সাহাবায়ে কিরাম রা. এর ব্যস্ত থাকা ইত্যাদি।

এসব কারণে নবী সা. এর যুগ থেকে তাবিয়ীনের যুগ পর্যন্ত মৌখিক বর্ণনার তুলনায় সংকলনের প্রচলন ছিল কম। মোটকথা, প্রিয়নবী সা. এর যুগে এমনকি সাহাবায়ে কিরাম রা. এর যুগেও কোন তাফসীর গ্রন্থ সংকলিত হয়নি। তবে তখন সংকলন কার্যক্রম যে একেবারেই ছিল না, বিষয়টি এমনও নয়। কারণ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, তখন হযরত আলী রা. ও হযরত উবাই ইবনে কা‘ব রা. এর পৃথক মাসহাফ ছিল। আর এসব মাসহাফে কুরআনী আয়াতের পাশাপাশি রাসূল সা. থেকে শ্রবণকৃত পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের তাফসীরও লেখা ছিল।

সাহাবায়ে কিরাম রা. এর যুগে কুরআনের তাফসীরের স্বতন্ত্র সংকলন না হলেও এ যুগের শেষ ভাগ থেকে শুরু হয়ে তাবিয়ীগণের যুগ হতেই তাফসীর সংকলনের ধারা সূচিত হয়। সে হিসাবে ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী প্রথম হিজরী শতাব্দী সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই অন্তত ৩ টি তাফসীর সংকলনের প্রমাণ পাওয়া যায়।

সেগুলো হচ্ছে যথাক্রমে: ১. তাফসীরে মুজাহিদ র.। ২. তাফসীরে সাঈদ ইবনে জুবাইর র. ও ৩. তাফসীরে আবুল আলিয়া র.।

তাফসীরে মুজাহিদ র.

ফজল বিন মাইমুন হজরত মুজাহিদ র. থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন,-“আমি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর নিকট পূর্ণ কুরআন তিনবার অধ্যয়ন করেছি। প্রত্যেক আয়াতে থেমে থেমে প্রশ্ন করেছি। কখন কিভাবে অবতীর্ণ হয়েছে তা জেনেছি।” (তাহযীবুত্ তাহযীব: খ-১০, পৃ-৪৩)
অনুরূপভাবে বর্ণিত আছে যে, ইবনে আবু মুলাইকা বলেছেন-“আমি হজরত মুজাহিদ র. কে দেখেছি তিনি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে কুরআনের তাফসীর সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন, আর তার হাতে কাগজ থাকত। তখন ইবনে আব্বাস রা. তাকে লিখতে বলতেন। এভাবে মুজাহিদ র. তাঁর নিকট থেকে পূর্ণ তাফসীর লিখে রাখেন।” (তাফসীরে তাবারী: খ-১,পৃ-২১)

উল্লেখ্য যে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর ইনতিকাল হয়েছে ৬৮ হিজরীতে। সুতরাং তাফসীরে তাবারীর উক্ত বর্ণনা দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, হজরত মুজাহিদ র. কর্তৃক তাফসীর সংকলনের এ কৃতিত্বপূর্ণ কর্মটি ৬৮ হিজরীর পূর্বেই সম্পাদিত হয়েছিল। তবে হজরত মুজাহিদ র. এর নিজের উদ্যোগে সংকলিত সেই তাফসীর গ্রন্থটি কত সময় পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল, তা জানা যায়নি। বর্তমানে তাফসীরে মুজাহিদ নামে বিভিন্ন সংকলক কর্তৃক সংকলিত তাফসীর গ্রন্থ পাওয়া যায়। এসবের মধ্যে কোনটিই হজরত মুজাহিদ র. এর নিজের সংকলিত নয়। বরং এসব কিতাবে হজরত মুজাহিদ র. থেকে বর্ণিত তাফসীরী রিওয়ায়াতগুলো একত্রিত করা হয়েছে মাত্র। তাফসীরে মুজাহিদ নামক এমন দু’টি কিতাবের সন্ধান আমরা পেয়েছি। তম্মধ্যে একটি শায়খ আবু মুহাম্মদ এর তাহকীক সম্বলিত দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা বৈরুত থেকে ১৪২৬ হিজরীতে প্রকাশিত। এক খন্ডে প্রকাশিত এ কিতাবে তাফসীর সংক্রান্ত ২০৯৯ টি রিওয়ায়েত স্থান পেয়েছে। আর অপরটি ড. আহমাদ আল-উমরানী এর তাহক্বীক সম্বলিত দারুস্সালাম মিসর থেকে প্রকাশিত। দুই খন্ডে প্রকাশিত এই কিতাবে হজরত মুজাহিদ র. থেকে বর্ণিত ৪৫৯৫ টি তাফসীরী রিওয়ায়াত স্থান পেয়েছে। এছাড়া ৫৪৪ হিজরীতে সংকলিত সাত খন্ডবিশিষ্ট তাফসীরে মুজাহিদ এর একটি পান্ডুলিপি দারুল কুতুবিল মিসরিয়্যাতে ছিল বলে জানা যায়।
হজরত মুজাহিদ বিন জাব্র র. তাবিঈ মুফাসসিগণের মধ্যে অন্যতম ইমাম ছিলেন। তাঁর তাফসীর সম্পর্কে হজরত সুফয়ান ছাওরী র. বলেন, যখন তোমার নিকট মুজাহিদ র. এর কোন তাফসীর পেশ করা হয় তখন তোমার জন্য তাই যথেষ্ট। ইবনে তাইমিয়া র. বলেন, এ জন্য ইমাম শাফিঈ র. ও ইমাম বুখারী র. সহ অনেকে তাঁর তাফসীরের উপর নির্ভর করতেন। তবে প্রখ্যাত মুফাসসির হজরত আ‘মাশ র. তাঁর সমালোচনা করতেন। সমালোচনার কারণ সম্ভবত এই ছিল যে, তিনি তাফসীর সম্পর্কে আহলে কিতাবের নিকট জিজ্ঞাসা করতেন। (মীযানুল ই‘তিদাল: খ-৩,পৃ-৪৩৯)

 তাফসীরে সাঈদ ইবনে জুবাইর র.

প্রথম শতাব্দীতে সংকলিত তাফসীরগুলোর মধ্যে আরেকটি তাফসীর গ্রন্থ হচ্ছে তাফসীরে সাঈদ বিন জুবাইর। জানা যায়, খলীফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের অনুরোধে প্রখ্যাত তাবিঈ হজরত সাঈদ বিন জুবাইর র. একটি তাফসীর গ্রন্থ সংকলন করেছিলেন। এ গ্রন্থটিই তাফসীরে সাঈদ বিন জুবাইর নামে পরিচিত। হজরত আতা বিন দীনার র. তাঁর দেওয়ানে এ তাফসীর গ্রন্থটি পেয়েছিলেন। (তাহযীবুত তাহযীব: খ-৪, পৃ-১১)
উল্লেখ্য যে, খলীফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের ইনতিকাল হয়েছিল ৮৬ হিজরীতে। আর হজরত সাঈদ বিন জুবাইর র. এর ইনতিকাল হয়েছে ৯৫ হিজরীতে। সুতরাং এ তাফসীর গ্রন্থটি যে ৮৬ হিজরীর পূর্বে এবং প্রথম শতাব্দীতে সংকলিত হয়েছিল, তা সহজেই প্রমাণিত হয়। হজরত ইবনে হাজার আসকালানী র. সহ আরো অনেকের মতে এ তাফসীর গ্রন্থটিই হচ্ছে সর্বপ্রথম সংকলিত পবিত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ তাফসীর গ্রন্থ। কালের পরিক্রমায় সেই তাফসীর গ্রন্থটি বিলীন হয়ে গিয়েছে। স্মরণীয় যে, বর্তমানে তাফসীরে সাঈদ বিন জুবাইর নামে যে তাফসীর গ্রন্থ পাওয়া যায়, তা হজরত সাঈদ বিন জুবাইর র. এর নিজের সংকলিত সেই ঐতিহাসিক তাফসীর গ্রন্থ নয়। বরং এসব তাফসীর গ্রন্থে বিভিন্ন কিতাবে উল্লিখিত হজরত সাঈদ বিন জুবাইর র. হতে বর্ণিত তাফসীর সংক্রান্ত রিওয়ায়াতগুলো একত্রিত করা হয়েছে মাত্র। তাফসীরে সাঈদ বিন জুবাইর নামক এমনই একটি তাফসীর গ্রন্থ আমাদের সংগ্রহে রয়েছে। ড. আহমাদ আল-উমরানীর তাহকীক সম্বলিত এবং দারুস্ সালাম মিসর থেকে এক খন্ডে ২০১১ তে প্রকাশিত উক্ত তাফসীর গ্রন্থে হজরত সাঈদ বিন জুবাইর র. হতে বর্ণিত ২২৬১ টি তাফসীরী রিওয়ায়াত রয়েছে।
হজরত সাঈদ বিন জুবাইর র. প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য তাবিয়ীগণের অন্যতম প্রধান ছিলেন। হজরত ইবনে আব্বাস রা.ও তাঁর কথার উপর নির্ভর করতেন। হজরত কাতাদাহ্ র. বলতেন, “মানুষের মাঝে চার ব্যক্তি চার বিষয়ে অধিক জ্ঞাত ছিলেন। আতা ইবনে রাবী হদ সম্পর্কে, সাঈদ ইবনে জুবাইর র. তাফসীর সম্পর্কে, হজরত ইকরিমা র. সীরাত সম্পর্কে ও হজরত হাসান বসরী র. হালাল-হারাম সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত ছিলেন।” তেমনিভাবে হজরত সুফয়ান ছাওরী র. বলেন, “তোমরা চার ব্যক্তির নিকট থেকে তাফসীর গ্রহণ কর- হজরত সাঈদ বিন জুবাইর র., হজরত মুজাহিদ র., হজরত ইকরিমা র. ও হজরত যাহ্হাক র.।”
(আল-ইসরাঈলিয়্যাত ওয়াল মউজু‘আত: পৃ-৯৫)

তাফসীরে আবুল আলিয়া র.

উপরোক্ত দু’টি তাফসীর গ্রন্থ ছাড়াও প্রথম হিজরী শতাব্দীতে আরো একটি তাফসীর গ্রন্থ সংকলিত হয়েছিল বলে জানা যায়। এ মর্মে ইমাম যাহাবী র. উল্লেখ করেছেন যে, হজরত আবুল আলিয়া রুফাই বিন মিহরান র্আরায়্যাহী র. প্রখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন সাহাবী হজরত উবাই বিন কা‘ব রা. থেকে পবিত্র কুরআনের তাফসীরের এক বিশাল পান্ডুলিপি তৈরী করেছিলেন। তাফসীর শাস্ত্রের অন্যতম ইমাম প্রখ্যাত তাবিয়ী হজরত আবুল আলিয়া র. ৯০ হিজরী মতান্তরে ৯৩ হিজরীতে ইনতিকাল করেছেন। সুতরাং এর দ্বারা সহজেই বোঝা যায় যে, তাঁর তাফসীর সংকলনের কাজ প্রথম শতাব্দীতেই সম্পন্ন হয়েছিল। জানা যায়, ইবনে জারীর ত্বাবারী র., আবু হাতিম র., ইমাম হাকিম র. ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল র. নিজ নিজ কিতাবে উক্ত পান্ডুলিপি হতে বহু সংখ্যক রিওয়ায়াত উল্লেখ করেছেন। তবে হজরত আবুল আলিয়া র. কর্তৃক সংকলিত সেই তাফসীর গ্রন্থটি কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। আর বর্তমানে তাফসীরে আবুল আলিয়া নামে যে তাফসীর গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়, সেটা তাঁর নিজের সংকলিত নয়। বরং বিভিন্ন কিতাবে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা হজরত আবুল আলিয়া র. থেকে বর্ণিত তাফসীরী রিওয়াতগুলো একত্রিত করার পর তাঁর নামের সাথে সম্পৃক্ত করে এ গ্রন্থটির নামকরণ করা হয়েছে।

তাফসীরে ইবনে আব্বাস রা.

সাহাবায়ে কিরামের মধ্য হতে হজরত ইবনে আব্বাস রা. হতেই সর্বাধিক তাফসীরী রিওয়ায়াত বর্ণিত রয়েছে। এ কারণেই তিনি “তরজুমানুল কুরআন”, “রঈসুল মুফাস্সিরীন” উপাধিতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. সম্পর্কে বলা হয় যে, তাঁর একটি তাফসীর গ্রন্থ ছিল, যা তিনি অন্যের মাধ্যমে সংকলন করিয়েছিলেন। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল র. উল্লেখ করেছেন যে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর তাফসীরের একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ মিসরেও ছিল। এ কারণেই তিনি বলেছেন, “মিসরে তাফসীরের একটি কিতাব রয়েছে, যদি কেউ কেবল সেটি দেখার উদ্দেশেই সেখানে সফর করে, তবে সেটা বাড়াবাড়ি হবে না।” (আল ইতকান:খ-২,পৃ-১৮৮)
অনেকের মতে ইমাম বুখারী র. উক্ত তাফসীরের উপর নির্ভর করেই বুখারী শরীফে কিতাবুত তাফসীর সংকলন করেছেন।
বাস্তবে হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. এর নিজের নিকট তাফসীরের সংকলিত কপি থাকার বিষয়টি নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত নয়। ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। আর এ কারণেই হজরত ইমাম বুখারী র. কুরআনের তাফসীর বিষয়ক রিওয়ায়াত গ্রহণের ক্ষেত্রে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর নিজের সংকলিত কপি হিসাবে প্রসিদ্ধ উক্ত কপির উপর নির্ভর করেননি, বরং হজরত আলী ইবনে আবি তালহা (মৃত: ১৪৩ হিজরী) এর সংকলিত সেই তাফসীর গ্রন্থের উপর নির্ভর করেছিলেন, যাতে তিনি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর তাফসীরী রিওয়ায়েতগুলো একত্রিত করেছিলেন। এ সম্পর্কে হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী র. বলেন, উক্ত কিতাবটি আবু সালিহের নিকট ছিল, যা তিনি মু‘আবিয়া বিন সালিহ হতে বর্ণনা করেন, আর তিনি বর্ণনা করেছেন আলী বিন আবি ত্বালহা হতে, আর তিনি হজরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণনা করেছেন। আর তাফসীর সংক্রান্ত হজরত ইবনে আব্বাস রা. এর বর্ণনা গ্রহণের ক্ষেত্রে এই আবু সালিহের সনদের উপরই নির্ভর করে ইমাম বুখারী র. নিজের সংকলিত হাদীছ গ্রন্থ বুখারী শরীফে কিতাবুত তাফসীর সংকলন করেছেন। (ফাতহুল বারী: খ- ,পৃ-?)

সহীফাতু আলী ইবনে আবি তালহা:

হজরত ইবনে আব্বাস রা. হতে রিওয়ায়াত কৃত হজরত আলী ইবন আবি তালহা র. এর সেই সংকলনটি ‘সহীফাতু আলী ইবনে আবি তালহা’ নামে পরবর্তিতে প্রকাশিত হয়েছে। এটা সর্বপ্রথম কখন প্রকাশিত হয়েছিল তা জানা সম্ভব না হলেও রাশিদ আব্দুল মুনঈমের তাহকীক ও তাখরীজসহ দারুল জেল বৈরুত থেকে ১৯৯৪ সনে তা প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়। এভাবে পরবর্তিতে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতেও এ গ্রন্থটি ছাপানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং সেগুলো প্রকাশিতও হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, তাফসীরে ইবনে আব্বাস রা. নামে এ পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রন্থ সংকলিত হয়েছে বলে জানা যায়। সেগুলোর মধ্য হতে দু’টি গ্রন্থ মা‘হাদের সংগ্রহে রয়েছে। মা‘হাদের সংগৃহীত দু’টি গ্রন্থের একটি হচ্ছে, আবু তাহির মুহাম্মদ বিন ইয়া‘কুব আল-ফিরোজাবাদী আশ্শাফিঈ কর্তৃক সংকলিত ‘তানবীরুল মিকয়াস মিন তাফসীরে ইবনে আব্বাস’। উক্ত গ্রন্থটিকে তানবীরুল মিকবাস নামেও অভিহিত করা হয়। তাফসীরে ইবনে আব্বাস নামে সংকলিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে এটিই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। অথচ এ গ্রন্থটিতে মুহাম্মদ ইবন মারওয়ান আস-সুদ্দী ‘আন মুহাম্মদ বিন আস্সায়িব আল-কালবী আন আবি সালিহ আন ইবনে আব্বাস রা. এই সনদে হজরত ইবনে আব্বাস রা. এর তাফসীরী রিওয়ায়াতগুলো একত্রিত করা হয়েছে। আর মুহাদ্দিসীনে কিরাম উপরোক্ত সনদকে ‘সিলসিলাতুল কাজিব’ অর্থাৎ মিথ্যা বর্ণনা সূত্র হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং এর উপর নির্ভর করা যায় না এবং হজরত ইবনে আব্বাস রা. এর নামের সাথে সম্পৃক্ত করে উক্ত কিতাবের নামকরণ করাও দুরস্ত নয়। (উলূমুল কুরআন লি-ত্বকী উসমানী:পৃ-৪৫৮)

উল্লেখ্য যে, তাফসীরে ইবনে আব্বাস এর উর্দূ ও বাংলা অনুবাদ হিসেবে বাজারে প্রসিদ্ধ তাফসীরটি উক্ত সনদেই বর্ণিত। সুতরাং বাংলা তাফসীরে ইবনে আব্বাস নামে পরিচিত গ্রন্থটি পরিত্যায্য।
এছাড়া মা‘হাদে সংগৃহীত তাফসীরে ইবনে আব্বাস নামক অপর কিতাবটি হচ্ছে, ড. আহমাদ আল-উমরানী এর তাহকীকসহ দারুস্সালাম কায়রো, মিসর হতে ৩ খন্ডে প্রকাশিত। এ গ্রন্থটিও নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ এতে হজরত ইবনে আব্বাস রা এর থেকে বর্ণিত তাফসীরী রিওয়ায়াতগুলো এমন এমন সনদে বর্ণনা করা হয়েছে যার কোনটি দুর্বল, কোনটি অধিকতর দুর্বল, আবার কোনটি প্রত্যাখ্যাত অথবা অন্য কোন অভিযোগে অভিহিত। সুতরাং এ গ্রন্থটিও নির্ভরযোগ্য নয়।

তাফসীরে ইবনে মাসউদ রা.

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর ন্যায় হজরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রা.ও ছিলেন প্রসিদ্ধ মুফাস্সিরে কুরআন সাহাবীগণের একজন। তাঁর থেকে বহুসংখ্যক তাফসীরী রিওয়ায়াত বর্ণিত রয়েছে। তবে নিজের জীবদ্দশায় তিনি কোন তাফসীর গ্রন্থ সংকলন করেছিলেন অথবা তৎকালে তাঁর তাফসীরী রিওয়ায়াত সমষ্টির কোন সংকলন করা হয়েছিল এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর হিজরী পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. এর তাফসীরী রিওয়ায়াতগুলোর একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। মুহাম্মদ আহমদ ঈসাবী এর তাহকীক সম্বলিত এ সংকলনটি ১৪০৫ হিজরী মুতাবেক ১৯৮৫ খৃস্টাব্দে সউদী আরবের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘মুআস্সাসাতুল মালিক ফয়সাল আল-খাইরিয়্যা’ ২ খন্ডে তাফসীরে ইবনে মাসউদ নামে প্রকাশ করেছে।

তাফসীরে উবাই ইবনে কা‘ব রা.

মুফাসসিরে কুরআন সাহাবীগণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন হজরত উবাই বিন কা‘ব রা.। তাঁর থেকেও অনেক তাফসীরী রিওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. এর ন্যায় তিনিও কোন তাফসীর গ্রন্থ সংকলন করেছিলেন বলে জানা যায়নি। তবে খৃস্টীয় চলতি শতাব্দীর শুরুর দিকে বিভিন্ন তাফসীর ও হাদীছ গ্রন্থে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা হজরত উবাই বিন কা‘ব রা. এর তাফসীরী রিওয়ায়াতগুলো একত্রিত করে সংকলনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। শায়খ আব্দুল জাওয়াদ কৃত এ সংকলনটি ‘তাফসীরুস্ সাহাবীয়িল জলীল উবাই বিন কা‘ব রা’. নামে ২০০১ সনে মিসরের দারুল বয়ান কায়রো থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

তাফসীরু উম্মিল মুমিনীন আয়িশা রা.

উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়িশা সিদ্দীকা রা. হতেও পবিত্র কুরআনের তাফসীর বিষয়ক বহু রিওয়ায়াত বর্ণিত আছে। বিভিন্ন তাফসীর ও হাদীছ গ্রন্থে ছড়িয়ে থাকা এসব রিওয়ায়াতগুলো একত্রিত করে সংকলনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি সম্পাদন করেছেন শায়খ সউদ বিন আব্দিল্লাহ। তাঁর কৃত এ অমূল্য সংকলনটি ‘মারবিয়াতু উম্মিল মুমিনীন আয়িশা রা.ফিত্তাফসীর’ নামে মাকতাবাতুত্ তাওবা, রিয়াদ থেকে ১৯৯২ সনে প্রকাশিত হয়েছে। অনুরূপভাবে আব্দুল্লাহ্ আবুস সউদ কৃত হজরত আয়িশা রা এর তাফসীরী রিওয়ায়াতগুলোর অপর একটি সংকলন ‘তাফসীরু উম্মিল মুমিনীন আয়িশা’ রা. নামে আলামুল কুতুব, কায়রো হতে ১৪১৬ মুতাবেক ১৯৯৬ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছে। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩০৪।

উল্লেখ্য যে, বর্তমানের তানবীরুল মিকয়াস মিন তাফসীরি ইবনি আব্বাস রা., তাফসীরু ইবনি আব্বাস রা., তাফসীরু ইবনি মাসউদ রা., তাফসীরু উবাই বিন কা‘ব রা. ইত্যাদি প্রথম শতাব্দীতে সংকলিত তাফসীর গ্রন্থ নয়। তবে যাঁদের তাফসীরী রিওয়ায়াতগুলো এসব কিতাবে জমা করা হয়েছে এবং যাদের নামের সাথে সম্পৃক্ত করে এসব কিতাবের নামকরণ করা হয়েছে, তারা প্রথম শতাব্দীর ছিলেন বিধায় প্রথম শতাব্দীর তাফসীর গ্রন্থসমূহের তালিকায় এসব কিতাবের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

চলমান পোষ্ট

মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।

সর্বশেষ পোস্ট

শীর্ষ লেখক

সর্বাধিক মন্তব্য

বৈশিষ্ট্যযুক্ত ভিডিও

ক্যাটাগরি