কুরআনে কারীমের মৌলিক হকগুলোর মধ্য হতে অন্যতম একটি হক হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত করা। এটা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি নফল ইবাদত। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, أفضل العبادة قراء ة القرآن ‘(সকল প্রকার নফল) ইবাদতের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত করা সর্বোত্তম।’ (কানযুল উম্মাল: ২২৬৩) এই পাক কালামের প্রতিটি হরফ তিলাওয়াতে দশটি ছাওয়াব লাভ হয়। এ মর্মে হাদীস শরীফে ইরশাদ
কুরআনে কারীমের মৌলিক হকগুলোর মধ্য হতে অন্যতম একটি হক হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত করা। এটা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি নফল ইবাদত। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, أفضل العبادة قراء ة القرآن
‘(সকল প্রকার নফল) ইবাদতের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত করা সর্বোত্তম।’ (কানযুল উম্মাল: ২২৬৩)
এই পাক কালামের প্রতিটি হরফ তিলাওয়াতে দশটি ছাওয়াব লাভ হয়। এ মর্মে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ তিলাওয়াত করবে সে এর বিনিময়ে একটি ছাওয়াব লাভ করবে। আর সেই ছাওয়াবটি হবে দশটি ছাওয়াব সমতুল্য। আমি একথা বলছি না যে, الم একটি হরফ; বরং ‘ا’ একটি হরফ, ‘ ل’ একটি হরফ ও ‘م’ একটি হরফ।’ (তিরমিযী: হাদীস নং-২৯১০)
এছাড়া গুনাহের কারণে মানুষের অন্তরে যে মরিচা জমে যায়, সেটা দূর করার উত্তম উপায় হচ্ছে অধিক পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করা। এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, লোহায় পানি লাগার কারণে তাতে যেরূপ মরিচা পরে তেমনি মানুষের অন্তরেও মরিচা পরে যায়। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল সেটা দূর করার উপায় কি? উত্তরে তিনি বললেন, মৃত্যুকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করা ও পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা। (বায়হাকী শু‘য়াবুল ঈমান: ৪/৫৭৮-৫৮০)
তেমনিভাবে নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াতের আরেকটি বিশেষ ফজীলত এই যে, তারা কিয়ামতের দিন কুরআনের সুপারিশ লাভ করবে। এ মর্মে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, রোযা ও কুরআন উভয়ই বান্দাহ্র জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও কামভাব হতে বিরত রেখেছি। সুতরাং আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কুরআন বলবে আমি রাতে তাকে নিদ্রা থেকে বিরত রেখিছি। সুতরাং আমার সুপারিশ কবুল করুন। অতঃপর উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। (আল-মুস্তাদরাক লিল হাকিম: ১/৫৫৪)
আর কুরআনের সুপারিশের গুরুত্ব যে আল্লাহ তা‘আলার নিকট কতটুকু বেশী। নি¤েœাক্ত হাদীস দ্বারা তা অনুমান করা যায়। হযরত জাবের রা. হতে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
عن جابر رضى الله عنه ان هذا القرآن شافع مشفع ، وماحل مصدق ، فمن جعله أمامه قاده الى الجنة ، ومن جعله خلفه ساقه إلى النار
‘কুরআন এমন সুপারিশকারী, যার সুপারিশ কবুল করা হবে এবং এমন বিতর্ককারী যার বিতর্ক মেনে নেওয়া হবে যে কুরআনকে সম্মুখে রাখবে কুরআন তাকে জান্নাতের দিকে টেনে নিবে। আর যে কুরআনকে পিছনে ফেলবে কুরআন তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে।’
(সহীহ্ ইবনু হিব্বান: ১৭৯৩)
কুরআন তিলাওয়াতের এমন ফজীলত জানার পরও যারা কুরআন তিলাওয়াত করে না, তারা যে কেবল তিলাওয়াতের ফজীলত বঞ্চিত হবে তাই নয়; বরং কুরআনের অভিযোগের তীর তাদের শরীরেও বিদ্ধ হবে।
এ মর্মে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
عن أنس رضى الله قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ألا من تعلم القرآن وعلمه فعلق مصحفا فى منزله ولم يتعهده ولم ينظر فيه يجيئ يوم القيامة معلقا به يقول يارب العالمين عبدك هذا يتخذنى مهجورا فاقض بينى وبينه
‘হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কুরআন শিখে ও ভালভাবে তা অনুধাবন করে অতপর কুরআনের কপি ঘরে ঝুলিয়ে রাখে,রীতিমত তিলাওয়াত করে না এবং তার বিধানসমূহও পালন করে না, কিয়ামতের দিন সে কুরআন গলায় ঝুলন্ত অবস্থায় কবর হতে উঠবে। কুরআন (তার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ দায়ের করে) বলবে- হে আল্লাহ! আপনার এ বান্দা আমাকে পরিত্যাগ করেছিল। এখন আপনি আমার ও তার মাঝে ফয়সালা করে দিন।’ (কিতাবু লামহাতিল আনওয়ার: ১/৩৫৩)
সুতরাং কুরআনের হক আদায়, ছাওয়াব লাভ ও অন্তরের মরিচা দূর করাসহ আরো বহু ফজীলত প্রাপ্তি ও কুরআনের অভিযোগ হতে মুক্তি লাভের নিমিত্তে আমাদের সকলেরই নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা জরুরী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াত করা তো দূরের কথা, আমাদের অধিকাংশের অবস্থাই এরূপ যে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ এমনকি মাসের পর মাস অতিবাহিত হয়ে যায়, অথচ এ দীর্ঘ সময়ে আমাদের কুরআন হাতে নিয়ে কয়েকটি আয়াতও তিলাওয়াতের সুযোগ হয় না। এটা চরম দুর্ভাগ্যের কথা। তাছাড়া অল্প কিছুসংখ্যক ব্যক্তি যারা প্রতিদিন সামান্য পরিমাণ হলেও কুরআন তিলাওয়াতের চেষ্টা করে থাকি তাদের তিলাওয়াত সহীহ্-শুদ্ধ নয়; বরং শৈশবে মক্তবের শিক্ষক হতে যা শিখেছি সেটাকেই পুঁজি করে এবং পূর্বের সেই নিয়মেই কুরআন তিলাওয়াত করে যাচ্ছি। আমাদের তিলাওয়াত আদৌ শুদ্ধ হচ্ছে কী না অথবা কতটুকু শুদ্ধ আর কতটুকু অশুদ্ধ? সে বিষয়টি যাচাইয়েরও কোন চিন্তা-ফিকির করছি না। এমনকি আমাদের অনেকের অবস্থাতো এমন যে, কেউ যদি তার তিলাওয়াতের ত্রুটি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাহলে যথারীতি বিরক্তি প্রকাশ করেন। এটা একেবারেই অনুচিত।
বর্তমানে নূরানী পদ্ধতিতে স্বল্প সময়ে কুরআন শিক্ষার যে সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে আমাদের জন্য মহান আল্লাহ পাকের নিয়ামত মনে করে যাদের তিলাওয়াত অশুদ্ধ তাদের সকলেরই সেখানে অংশ গ্রহণ করা অথবা অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করে পবিত্র কুরআনের তিলাওয়াত বিশুদ্ধ করা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সকলের জন্যই অপরিহার্য। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা তারতীলের সাথে কুরআন তিলাওয়াতের নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে- وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيْلاً
‘আর আপনি তারতীলের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করুন।, (সূরাহ্ মুয্যাম্মিল: ৪)
আর তারতীল অর্থ হচ্ছে, প্রতিটি হরফকে নিজ নিজ মাখরাজ হতে সঠিকভাবে উচ্চারণ করার সাথে তাজবীদের নিয়ম -নীতি অনুস্মরণ করে ধীরগতিতে কুরআন তিলাওয়াত করা। সুতরাং আমরা যদি তাজবীদের প্রতি পরিপূর্ণ লক্ষ্য না রেখে কুরআন তিলাওয়াত করি তাহলে আমাদের তিলাওয়াত শুদ্ধ হবে না। আর অশুদ্ধ তিলাওয়াতের ফলে আমরা যে কেবল ছাওয়াব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হব তাই নয়; বরং অনেক সময় অশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াতের ফলে অর্থও বিকৃত হয়ে যাবে। যার কারণে মারাত্মক গুনাহর বোঝাও বহন করতে হবে। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াতের ফলশ্রুতিতে পাক কালামের অর্থের বিকৃতি ঘটার দু’টি উদাহরণ অতি সংক্ষেপে পেশ করা হল।
১. সূরাহ্ ফাতিহার প্রথম আয়াতটি হচ্ছে “ اَلحَْمْدُ لِلَّهِ رَِبِّ الْعَالمَِيْنَ ”
উক্ত আয়াতের মধ্যে اَلْحَمْدُ শব্দের ح হরফটিকে যদি তার মাখরাজ হতে যথারীতি সহীহ্ভাবে উচ্চারণ করে পাঠ করা হয় তাহলে এ শব্দটির অর্থ হবে সকল প্রশংসা। আর পুরো আয়াতের অর্থ হবে ‘সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।’ পক্ষান্তরে যদি এ অক্ষরটিই উচ্চরণের ক্ষেত্রে সহীহ্ভাবে উচ্চারণের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া না হয়, তাহলে সেটা ‘ح’ অক্ষর না হয়ে ‘ه’ উচ্চারিত হবে। তখন শব্দটির উচ্চারণ হবে الهمد হিসাবে। আর الهمد এর অর্থ হচ্ছে সকল ছেঁড়া কাপড়। আয়াতটির অর্থ দাঁড়াবে ‘সকল ছেঁড়া কাপড় আল্লাহরই জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।’ নাউযুবিল্লাহ, কত জঘন্য ধরনের কুরআন বিকৃতি! আল্লাহর জন্য ছেঁড়া কাপড় সাব্যস্ত করা কিভাবে সম্ভব হবে? ছেঁড়া কাপড় কেন? তাঁর তো ভাল কাপড়ের ও বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই।
২. মক্কার মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুসলমানদের প্রতি চরম নির্মম নির্যাতন চালিয়েও দ্বীনে হক থেকে তাদেরকে বিরত রাখতে না পেরে কুরাইশ নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তাদের প্রতিনিধি এসে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এই বলে সন্ধির প্রস্তাব পেশ করল, হে মুহাম্মদ! আমরা সকলেই কুরাইশ গোত্রের। পারস্পরিক দ্বন্দ-কলহ নিন্দনীয়। সুতরাং নিজেদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের অবসানকল্পে আমি এ প্রস্তাব পেশ করছি যে, বৎসরে ছয় মাস আমরা তোমার রবের উপাসনা করব, আর পরবর্তী ছয় মাস তুমি আমাদের দেবী-দেবতার পূজা-অর্চনা করবে।’ এরই প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা সূরাহ্ কাফিরুন অবতীর্ণ করেন। উক্ত সূরাহ্র প্রথম দু’টি আয়াত নিম্নরূপ,
قُلْ ياَيُّهَا الْكفِرُوْنَ ۞ لاَ اَعْبُدُ مَاتَعْبُدُوْنَ ۞
‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন, হে কাফেররা! আমি ইবাদত করব না তাদের যাদের ইবাদত তোমরা কর।’
এ সহীহ্্ অর্থটি তখনই হবে যদি আমরা দ্বিতীয় আয়াতের لا اعبد এর لا হরফটি লম্বা করে পাঠ করি। আর যদি ভুলবশতঃ উক্ত হরফটি লম্বা না করে তাড়াতাড়ি করে لاعبد পাঠ করি তখন উক্ত অর্থ বিকৃত হয়ে নতুন অর্থ দাঁড়াবে ‘আমি অবশ্যই ইবাদত করব (তাদের) , যাদের ইবাদত তোমরা কর। নাউযুবিল্লাহ। অশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াতের ফলে নিজেদের অজান্তেই এ ধরনের হাজারো কুরআন বিকৃতির সাথে আমরা জড়িয়ে পড়ি।
তাছাড়া আমরা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে থাকি। নামাযের একটি অন্যতম রুকন হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত করা। এমতাবস্থায় আমাদের কুরআন তিলাওয়াত যদি সহীহ্ না হয় তবে আমাদের নামাযও সহীহ্-শুদ্ধ হবে না। অথচ নামাযে যুগ যুগ ধরে এই অশুদ্ধ অবস্থায় আমরা কুরআন পাঠ করে যাচ্ছি। তবে অশুদ্ধ কুরআন পাঠের ফলে নামায যে শুদ্ধ হয় না, এ বিষয়টি জানার পর কেউ যদি সহীহ্-শুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা গ্রহণ আরম্ভ করে তাহলে নিয়মিত চেষ্টার মাধ্যমে সহীহ্-শুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত শিখতে যে সময়টুকু ব্যয় হয়, এ সময়টুকুর নামায অবশ্য অশুদ্ধ অবস্থায় কুরআন পাঠই আল্লাহ তা‘আলা কবুল করবেন বলে আশা করা যায়।
মতামত দিন
আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।