তা‘বীল-এর অর্থ -ও তাফসীর- তাবীলের- পার্থক্য

তা‘বীল-এর অর্থ -ও তাফসীর- তাবীলের- পার্থক্য
মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলামতা‘বীল শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ ও তা‘বীল শব্দের ব্যবহার

তা‘বীল এর অর্থ ও তাফসীর তাবীলের পার্থক্য তাবীল শব্দের আভিধানিক অর্থ تأويل শব্দটি أوْلٌ (ফিরা) মূলধাতু হতে উদগত, باب تفعيل এর মাসদার (أَوَّلََ يُؤَوِّلُ تأْوِيْلاً) হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ: ফিরানো, ব্যাখ্যা করা, তাবীল করা। যেমন বলা হয়: فكأن المؤول أرجع الكلام الى مايحتمله من المعانى অর্থাৎ“তাবীলকারী বা ব্যাখ্যাদানকারী ব্যক্তি তার কথাকে সম্ভাব্য কোন অর্থের

তা‘বীল এর অর্থ ও তাফসীর তাবীলের পার্থক্য
তাবীল শব্দের আভিধানিক অর্থ

تأويل শব্দটি أوْلٌ (ফিরা) মূলধাতু হতে উদগত, باب تفعيل এর মাসদার (أَوَّلََ يُؤَوِّلُ تأْوِيْلاً) হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ: ফিরানো, ব্যাখ্যা করা, তাবীল করা। যেমন বলা হয়: فكأن المؤول أرجع الكلام الى مايحتمله من المعانى
অর্থাৎ“তাবীলকারী বা ব্যাখ্যাদানকারী ব্যক্তি তার কথাকে সম্ভাব্য
কোন অর্থের দিকে ফিরায়।”
তাবীল শব্দের ব্যবহার
تأويل শব্দটি কুরআনে কারীমে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে
১. তাফসীর করা, যেমন ইরশাদ হয়েছে:
وابتغاء تأويله وما يعلم تأويله الا الله. سورة ال عمران-٧
২.পরিণাম, যেমন ইরশাদ হয়েছে:
ذلك خيروأحسن تأويلا. سورة النساء- ٥٩
৩. প্রদত্ত সংবাদ বাস্তবায়ন হওয়া, যেমন ইরশাদ হয়েছে:
هل ينظرون الاتأويله يوم يأتى تأويله. سورة الاعراف- ٥٣
ولما يأتهم تأويله . سورة يونس- ٣٩
৪. স্বপ্ন ব্যাখ্যা যেমন ইরশাদ হয়েছে:
هذا تأويل رؤياى من قبل. سورة يوسف – ١٠٠
৫.কাজের ব্যাখ্যা প্রদান, (কথার নয়,) যেমন ইরশাদ হয়েছে:
سأنبئك بتأويل مالم نستطع عليه صبرا . سورة الكهف – ٧٨
ذلك تأويل مالم تسطع عليه صبرا. سورة الكهف – ٨٢
আততাফসীর ওয়াল মুফাসসিরুন: খ-১, পৃষ্ঠা-২০,
তাবীল শব্দের পারিভাষিক অর্থ
تأويل শব্দের পারিভাষিক অর্থে علماء المتقدمين ও علماءالمتأخرين এর মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে।
علماء المتقدمين তথা পূর্ববর্তী উলামায়ে কিরামের নিকট تأويل শব্দের পারিভাষিক ভিন্ন কোন অর্থ নেই বরং; তাফসীর ও তাবীল একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন হযরত মুজাহিদ রহ. এর উক্তি
“ان العلماء يعلمون تأويله أى القران” অর্থাৎ “নিশ্চয় উলামায়ে কিরাম কুরআনে কারীমের তাবীল তথা ব্যাখ্যা জানেন।” এছাড়া আবু জা‘ফর মুহাম্মদ ইবনে জারীর ত্ববারী রহ. তাঁর কৃত তাফসীর “তাফসীরে ত্ববারী” এর মাঝে القول فى تأويل قوله تعالى كذا وكذا এবং إختلف اهل التأويل فى هذه الاية
বাক্যদ্বয়ের মাঝে ব্যবহারকৃত تأويل শব্দটি দ্বারা তাফসীরই উদ্দেশ্য নিয়েছেন। উল্লিখিত মতানুসারে تأويل শব্দের ভিন্ন কোন সজ্ঞার প্রয়োজন নেই।
علماء المتأخرين তথা পরবর্তী উলামায়ে কিরামের নিকট تأويل শব্দটি তাফসীরের অর্থে নয়; বরং ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে সে হিসাবে تأويل শব্দের পারিভাষিক অর্থ হল: هوصرف اللفظ عن المعنى الراجح الى المعنى المرجوح لدليل يقترن به
অর্থাৎ “শব্দের সাথে সম্পৃক্ত কোন দলীলের ভিত্তিতে রাজেহ্ অর্থকে মারজু-হ অর্থের দিকে ফিরানো।”
আত্তাফসীর ওয়াল মুফাসসিরুন:খ-১, পৃষ্ঠা-২০
তাফসীরে মাতুরীদী:খ-১, পৃষ্ঠা-১৮৩

তাফসীর ও তা‘বীলের মাঝে পার্থক্য
১. আবু উবাইদা মা‘মার ইবনুল মুসান্না আত্তাইমী (মৃত:২১০) এবং অধিকাংশ উলামায়ে কিরামের অভিমত হল:
“তাফসীর ও তাবীল শব্দদ্বয়ের মাঝে কোন পার্থক্য নেই বরং উভয় শব্দ একই অর্থে অর্থাৎ তাফসীর অর্থে ব্যবহৃত হয়।”
২. ইমাম আবু মানসুর মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে মাহমুদ আল-মাতুরীদী রহ. (মৃত:৩৩৩হি.) বলেন: (التفسير: القطع على ان المراد من اللفظ هذا . والشهادة على الله أنه عنى باللفظ هذا فإن قام دليل مقطوع به فصحيح . والافتفسيربالرأى وهو المنهى عنه. والتأويل: ترجيح احد المحتملات بدون قطع والشهادة على الله )
অর্থাৎ“তাফসীর হল কোন শব্দের নিশ্চিত অর্থ বর্ণনা করা এবং এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ তা‘আলা শব্দ দ্বারা এটাই উদ্দেশ্য নিয়েছেন। অতপর যদি সে ব্যপারে কোন দলীল পাওয়া যায় তাহলে সেটা সঠিক তাফসীর অন্যথায় সেটা তাফসীর বিররায় যা পরিত্যাজ্য। আর তাবীল হল শব্দের সম্ভাব্য কোন অর্থকে সম্ভাবনার ভিত্তিতে প্রাধান্য দেয়া ।
৩. ذكر جملة من العلماء من أن التفسير يرجع الى الرواية. والتأويل يرجع الى الدراية والإستنباط
অর্থাৎ“ তাফসীর রিওয়ায়াত এর সাথে সম্পৃক্ত আর তাবীল হল দিরায়াত ও ইস্তিম্বাত এর সাথে সম্পৃক্ত।
৪. আল্লামা রাগেব ইস্ফাহানী রহ. বলেন: তাফসীর তাবীল থেকে عام তবে তাফসীর শব্দের ব্যবহার সাধারণত ألفاظ এর ক্ষেত্রে আর তাবীল এর ব্যবহার معانى এর ক্ষেত্রে এবং তাফসীর অধিকাংশ ক্ষেত্রে مفردات এর মাঝে আর তাবীল অধিকাংশ ক্ষেত্রে جمل এর মাঝে ব্যবহার হয়। তাবীল অধিকাংশ ক্ষেত্রে كتب الهية এর ক্ষেত্রে আর তাফসীর সাধারণত كتب الهية وغير الهية উভয়টির মাঝে ব্যবহার হয়।
(তাফসীরে মাতুরীদী: খ-১,পৃ-১৮৫)
(আত্তাফসীর ওয়ালমুফাসসিরুন:খ-১,পৃ-২২)

তাফসীরুল কুরআনের প্রয়োজনীয়তা
আল্লাহ তা‘আলা মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সার্বিক কল্যাণের জন্য অবতীর্ণ করেছেন মহাগ্রন্থ আলকুরআন। মানব জীবনের সকল কাজের দিক-নির্দেশনা ও অকল্যাণকর কাজের প্রতি নিষেধাজ্ঞার বিশদ বিবরণ এতে বর্ণিত রয়েছে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে। তেমনিভাবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সবধরনের সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান দিয়েঝে আলকুরআন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন: ونزلنا عليك الكتب تبيانا لكل شيئ. سورة النحل-٨٩ অর্থ: আমি তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ। সুতরাং উভয় জাহানের কল্যাণ লাভের জন্য কুরআনের উপর আমল করা আমাদের সকলের জন্যই অপরিহার্য। তবে কুরআনের উপর আমল করার পূর্বশর্ত হচ্ছে কুরআন বুঝা ও তত্ত্ব-মর্ম গভীরভাবে উপলব্ধি করা। যেহেতু মানুষের জ্ঞান সীমিত, সুতরাং সীমিত জ্ঞান দ্বারা মহান আল্লাহ তা‘আলার কালামের যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করা সত্তিই দু:সাধ্য। বিধায় মানুষকে কুরআন বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর অর্পণ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে: وانزلنا اليك الذكر لتبين للناس مانزل اليهم . سورة النحل- ٤٤ অর্থ: আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষকে স্পষ্টরূপে জানিয়ে দাও তাদের প্রতি কী অবতীর্ণ করা হয়েছে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথরূপে আঞ্জাম দিয়েছেন। সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী কুরআন বুঝা এবং এর তত্ত্ব-মর্ম উপলব্ধির জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করা অপরিহার্য আর সে বিষয়ে সতর্ক করে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে স্পষ্টভাবে ইরশাদ করেছেন।كتاب انزلناه اليك مبارك ليدبروا اياته . سورة ص- ٢٩ অর্থ: বরকতপূর্ণ এক কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ কিতাবের আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে: افلايتدبرون القران ولوكان من عند غيرالله لوجدوا فيه اختلافا كثيرا. سورة النساء-٨٢ অর্থ:(তারা কি কুরআন থেকে বিমুখ হবে) অতপর কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা করবেনা? অথচ কুরআন যদি আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া ভিন্ন কারো পক্ষ থেকে হত, তাহলে তারা তাতে অনেক মতানৈক্য পেত। এ ব্যাপাওে আল্লাহ তা‘আলা আরো ইরশাদ করেন: افلايتدبرون القران ام على قلوب اقفالها. سورة محمد- ٢٤ অর্থ: তারা কি কুরআনে কারীমের অর্থ উপলব্ধি করতে গবেষণা করবেনা, না তাদের অন্তরসমূহ তালাবদ্ধ?। কুরআনের আয়াতসমূহ নিয়ে তাদাব্বুর করা, কুরআনের বিধান অনুযায়ী আমল করা কালামুল্লাহ সহীহ তাফসীর জানার উপর নির্ভরশীল। আর এটাতো সত্য যে, কুরআনে পাকের সকল আয়াতের তাফসীর আরবী ভাষা জানার দ্বারা সম্ভব নয়,যার কারণে দেখা যায় সাহাবায়ে কিরামের ভাষা আরবী হওয়া সত্ত্বেও বহু আয়াতের তাফসীর জানতে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শরণাপন্ন হয়েছেন এবং প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট হতে, পরবর্তীতে কিবারে সাহাবা রা. হতে সেগুলোর সঠিক সমাধান লাভ করেছেন। এ সম্পর্কে হযরত আলী রা. এর উক্তি উল্লেখযোগ্য
روى معمر عن وهب بن عبد الله عن ابى الطفيل قال: شهدت عليا يخطب وهويقول:سلونى فوالله لا تسئلونى عن شيئ الااخبرتكم به وسلونى عن كتاب الله فوالله ما من اية الاوانا اعلم ابليل نزلت ام بنهار؟ ام فى سهل ام فى جبل
কুরআনে কারীমের তাফসীর জানার ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কিরাম রা. কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করেছেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ইবনে মাসউদ রা. এর নিম্নোক্ত উক্তি দ্বারাই এর কিছুটা প্রমান পাওয়া যায়।
روى البخارى فى صحيحه بسنده عن ابن مسعود قال: والله الذى لااله غيره ما انزلت اية من كتاب الله الا وانا اعلم اين نزلت ولا نزلت اية من كتاب الله الا وانا اعلم فيمن نزلت ولو اعلم احدا اعلم بكتاب الله منى تبلغه الابل لركبت اليه
সাহাবায়ে কিরাম রা. কুরআনে কারীমের সহীহ তাফসীর আতœস্থ করেই ক্ষান্ত হননি; বরং পরবর্তী উম্মতগনের নিকট পৌঁছানোর জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করে গেছেন। কারণ তারা এ বিষয়টি পুরোপুরী উপলব্ধি করেছিলেন। শরয়ী বিধান সমূহের মূল উৎস ও হিদায়াতের আলোকবর্তিকা আল্লাহ তা‘আলার এ কিতাব। সুতরাং যদি এর সহীহ তাফসীর পরবর্তী উম্মত অবগত হতে না পারে তাহলে সহীহ দ্বীন ও শরীয়ত অবশিষ্ট থাকবেনা। আর সে জন্যই তাঁরা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রসিদ্ধ নগরীগুলোতে তাফসীরুল কুরআনের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান কায়েম করে, কুরআনের তাফসীর শিক্ষা দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তাফসীরুল কুরআনের এসব মাদরাসারগুলোর মধ্য হতে مدرسة مكة . مدرسة المدينة . مدرسة الشام. مدرسة مصر ومدرسة اليمن বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদেরএরূপ প্রানপন প্রচেষ্টার ফলে তাবেয়ীগনের মধ্য হতে মুফাসসিরে কুরআন এর বিরাট এক জামাত তৈরী করা সম্ভব হয়। আর সাহাবায়ে কিরাম রা. এর হাতে গড়া এসকল তাবেয়ীর মাধ্যমে তাফসীরুল কুরআনের সবচেয়ে বেশী খিদমাত আঞ্জাম পায়। এবং তারাও তাফসীরুল কুরআনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি কওে পরবর্তীদের নিকট কুরআনে কারীমের সহীহ তাফসীর পৌঁছানোর এবং সহীহ তাফসীর সম্পর্কে তাদেরকে যথার্থরূপে অবহিত করার গুরু দায়িত্ব পরিপূর্ণরূপে পালন করেন। পরবর্তীদের অনুসরনে এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। আমাদের আকাবিরদের এই চরম ত্যাগ ও কঠোর সাধনার ফলেই আজ আমরা সহীহ তাফসীর সম্পর্কে জানতে সক্ষম হয়েছি।

চলমান পোষ্ট

মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।

সর্বশেষ পোস্ট

শীর্ষ লেখক

সর্বাধিক মন্তব্য

বৈশিষ্ট্যযুক্ত ভিডিও

ক্যাটাগরি