আল কুরআনের অনুবাদ শিক্ষার কলা কৌশল

  আল কুরআনের অনুবাদ শিক্ষার কলা কৌশল ড. এ. বি. এম হিজবুল্লাহ সাহেব ১. অনুবাদের প্রাথমিক কথাঃ বহু ভাষার এ পৃথিবীতে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে অনুবাদ। প্রাচীন কালে রাজ দরবারে দোভাষী থাকত। দোভাষীর মাধ্যমে ভাব ও আলাপ আলোচনার আদান প্রদান হত। অনুবাদ না থাকলে বিভিন্ন ভাষায় রচিত বহু মূল্যবান গ্রন্থ হয়ে পড়ত মূল্যহীন। অনুবাদের

 

আল কুরআনের অনুবাদ শিক্ষার কলা কৌশল
ড. এ. বি. এম হিজবুল্লাহ সাহেব

১. অনুবাদের প্রাথমিক কথাঃ

বহু ভাষার এ পৃথিবীতে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে অনুবাদ। প্রাচীন কালে রাজ দরবারে দোভাষী থাকত। দোভাষীর মাধ্যমে ভাব ও আলাপ আলোচনার আদান প্রদান হত। অনুবাদ না থাকলে বিভিন্ন ভাষায় রচিত বহু মূল্যবান গ্রন্থ হয়ে পড়ত মূল্যহীন। অনুবাদের মাধ্যমেই মানুষ জানতে পারে বিভিন্ন দেশ ও জাতির ইতিহাস। বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে রচিত গ্রন্থের মূল্যবান তথ্য। জ্ঞান বিজ্ঞানে সাধিত হয় উৎকর্ষ। সাহিত্যে সৃষ্টি হয় প্রাণের সঞ্চার। তাই আজ অনুবাদ এক আকর্ষণীয় শিল্প। অনুবাদ মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ইসলামের যুগে আমরা দেখতে পাই অনুবাদের ব্যবহার। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু অলাইহি ওয়া সাল্লাম রাজা বাদশাহদের নিকট চিঠি পাঠিয়েছেন। তার সাথে পাঠিয়েছেন দোভাষী অনুবাদকও। হযরত উমার (রা) অধ্যয়ন করেছেন আরবীতে অনুদিত তাওরাত। পরবর্তিতে এ ধারা হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে যেতে থাকে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় শুরু হয় নিয়মিত অনুবাদ। ‘খ্রীষ্টিয় নবম শতাব্দীতে খলিফা মনসুরের পথ ধরে আব্বাসীয় সপ্তম খলীফা মামুন (রা. কা. ৮১৩-৮৩৩ খ্রীঃ) ‘বায়তুল হিকমাহ’ নামক জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র স্থাপন করেন। এই সার্বজনীন ও বৃহত্তর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরকারী খরচে গ্রীসের চিকিৎসাশাস্ত্র ও দর্শন বিজ্ঞান থেকে শুরু করে প্লেটো ও এরিস্টোটটল
প্রমুখের রচনার আরবী তরজমা এবং ভারতের হিন্দু দর্শন ও অন্যান্য সাহিত্য সম্ভারও আরবীতে অনুদিত হয়েছিল। (ড. মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান, বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা:পৃ-২)

২. অনুবাদের সংজ্ঞা
ক. অনুবাদের আভিধানিক অর্থঃ আভিধানিক অর্থে অনুবাদকে বাংলায় বলা হয় ভাষান্তর। আরবীতে বলা হয় তরজমা ইংরেজীতে বলা হয় Translation

খ. অনুবাদের পারিভাষিক অর্থঃ পারিভাষিক ও প্রচলিত অর্থে এক ভাষার কথা অন্য ভাষায় প্রকাশ করাকে অনুবাদ বা তরজমা বলা হয়। বাখ্যায় বলা যায় যে, এক ভাষার অর্থ, কথা বা ভাব অন্য ভাষায় প্রকাশ করাকে অনুবাদ বলা হয়। যিনি অনুবাদ করেন তাকে বলা হয় অনুবাদক। অনুবাদের মাধ্যমে এক ভাষার চিন্তা চেতনা, সাংস্কৃতি সভ্যতা, ইত্যাদি অন্য ভাষায় লিখিত বা শ্রুত আকারে বিনিময় বা আদান প্রদান করা হয়।

গ. অনুবাদের প্রকারভেদঃ অনুবাদকে চার ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন:
ক্র:                           বাংলা                          আরবী
০১ আক্ষরিক বা শাব্দিক অনুবাদ الترجمة الحرفية أو اللفظية أو المساوية
০২ ভাবানুবাদ বা মুক্ত অনুবাদ الترجمة الحرة أو التعبيرية
০৩ ব্যখ্যা বা বিশ্লেষণধর্মি অনুবাদ الترجمة التفسيرية أو الشارحة أو المعنوية
০৪ সংক্ষিপ্ত অনুবাদ الترجمة الملخصة

কিন্তু চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, অনুবাদ মৌলিকভাবে দু’প্রকার।
ক. আক্ষারক বা শাব্দিক অনুবাদ।
খ. ভাবানুবাদ বা মুক্ত অনুবাদ।

ভাবানুবাদ তিন ভাগে বিভক্ত।
ক. ভাবানুবাদ: শাব্দিক বা আক্ষরিক।
খ. ভাবানুবাদ: ব্যখ্যামূলক।
গ. ভাবানুবাদ: সংক্ষিপ্ত।

১. আক্ষরিক বা শাব্দিক অনুবাদঃ মূল ভাষার বিন্যাস ঠিক রেখে অনুবাদ করা। অর্থাৎ মূল ভাষার প্রতিটি শব্দে শব্দে যে অনুবাদ করা হয়। মূল ভাষার বাক্য বিন্যাস বহাল রেখে প্রতিটি শব্দের সমার্থক প্রতিশব্দ দ্বারা অনুবাদ করা। এ অনুবাদ প্রায় অসম্ভব। অবশ্য ছোট ছোট বাক্যে মোটামুটি শাব্দিক অনুবাদ সম্ভব হলেও খুব কমই এর প্রয়োগ করা যায়। মূল ভাষার সবকিছু ঠিক রেখে অনুবাদের ভাষায় ভাষান্তর সুকঠিন। কারন, সব ভাষারই নিজস্ব স্বকীয়তা রয়েছে। রয়েছে নিজস্ব ব্যবহারবিধি, ব্যকরণ নীতিমালা, সুর, ছন্দ, ব্যঞ্জনা জোযনা, বাচনরীতি, ইত্যাদি। আর একারনেই আক্ষরিক বা শাব্দিক অনুবাদকে অনেকে গ্রহণ করেন না।
২. ভাবানুবাদঃ মূল ভাষার কথা বা বক্তব্য দ্বারা যা বুঝা যায় শুধুমাত্র তার প্রকাশ। এক্ষেত্রে মূল ভাষার বাক্য বিন্যাস বহাল থাকা না থাকা বিবেচ্য থাকেনা। এখানে বিবেচ্য বিষয় হলো, বাক্য দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে তাই। অর্থাৎ, মূল ভাষার বক্তব্য পূর্ণাঙ্গ ও সুন্দরভাবে অনুদিত ভাষায় উপস্থাপন করা। আর এটাকেই ভাবানুবাদ: শাব্দিক বলা যায়।
৩. ব্যখ্যামূলক অনুবাদঃ ব্যখ্যামূলক অনুবাদ মূলতঃ ভাবানুবাদের বিশ্লেষনী অনুবাদ। ভাবানুবাদে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। আর ব্যখ্যামূলক অনুবাদে ভাবানুবাদের বিশ্লেষণ করা হয়। কোন শব্দ বা বাক্যের ব্যখ্যা বা বিশ্লেষণের মাধ্যমে মূল ভাষার বক্তব্য পূর্ণাঙ্গ ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। আর একে ভাবানুবাদঃ ব্যখ্যামূলক বলা যায়।
৪. সংক্ষিপ্ত অনুবাদঃ কোন গ্রন্থ বা বিষয়ের ভাব বা বক্তব্যকে সংক্ষিপ্তাকারে অনুবাদের মাধ্যমে উপস্থাপন করা। আর একে ভাবানুবাদঃ সংক্ষিপ্ত বলা যায়।
অতএব দেখা যাচ্ছে যে, শাব্দিক অনুবাদে অনুবাদক মূল ভাষার প্রতিটি শব্দের অর্থ বুঝতে চেষ্টা করে। অতঃপর প্রতিটি শব্দের বিপরিতে অনুবাদের ভাষার সমার্থক শব্দ ব্যবহার করে। এতে করে ভাষার ভিন্নতার কারনে মূল ভাষার বক্তব্য প্রায়শঃ অস্পষ্ট থেকে যায়। মূল ভাষার ব্যবহারবিধি, ব্যকরন নীতিমালা, ছন্দ ইত্যাদি হুবহু ব্যবহারের তো প্রশ্নই উঠেনা। যার কারনে পাঠক মূল ভাষায় রচিত বক্তব্যের ও সাহিত্যের রস আস্বাদনে বঞ্চিত হন।
অপরদিকে ভাবানুবাদে অনুবাদক মূল ভাষার বক্তব্য অনুধাবন করতে চেষ্টা করে। এরপর তিনি অনুদিত ভাষায়।
তা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেন। এতে মূল ভাষার বিন্যাসে আগপর বা কম বেশী হতে পারে। এখানে মূল ভাষার পরিবর্তে অনুদিত ভাষার রীতিনীতি অনুসৃত হয়। আর এ ভাবানুবাদই বর্তমান সময়ে স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক সেমিনার সিম্পোজিয়াম, সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ, বিবৃতি, বা ডকুমেন্ট, ইত্যাদিও ক্ষেত্রে প্রজোয্য। এখানে অনুবাদক মূল কথাটাই অনুবাদের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এখানে তিনি কোন অবস্থাতেই কমবেশী করতে পারেন না। বইপত্র অনুবাদের ক্ষেত্রে তা প্রজোয্য। কোন শব্দ বা বক্তব্যের ব্যখ্যা বা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হলে অনুবাদক তা ফুটনোটে বর্ণনা করবেন। আর এটাই বর্তমানে শাব্দিক অনুবাদ হিসাবে পরিচিত।
ব্যখ্যামূলক অনুবাদে মূল ভাষার বক্তব্য ঠিক রেখে ব্যখ্যা বা বিশ্লেষন করা হয়। এতে অবশ্যই কথামালা বৃদ্ধি পায়। আর এ ব্যখ্যামূলক অনুবাদ আমরা দেখতে পাই কুরআন, হাদীস, ফেকাহসহ বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন বিষয়ে লিখিত গ্রন্থ ও সাহিত্য চর্চায়।

বিভিন্ন প্রকার অনুবাদের কিছু উদাহরণঃ
শাব্দিক অনুবাদের উদাহরণ। যেমন: مااسمك؟। এখানে তিনটি শব্দ রয়েছে। ما، اسم، ك । অনুবাদক এখানে পর্যায়ক্রমে প্রথমে ما এরপর اسم তারপর ك এর অর্থ নির্ধারন করবেন। ما অর্থ: ‘কি’ (প্রশ্নবোধক) اسم অর্থ: ‘নাম’। ك অর্থ: তোমার (পুরুষ)। তাহলে مااسمك؟। এর শাব্দিক বা আক্ষরিক অনুবাদ হবে ‘কি নাম তোমার’ (পুরুষ)?  كيف حالك ؟। কেমন অবস্থা আপনার (পুরুষ)?

ভাবানুবাদ শাব্দিকঃ যেমন: أني لك هذا قالت هو من عند الله؟ তোমার জন্য এটা কোথেকে এলো? অথবা তুমি এটা কোথায় পেলে? তিনি বল্লেন, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে ইত্যাদি। এখানে যদি শাব্দিক অনুবাদ করা হয় তাহলে মূল বক্তব্য ব্যহত বা অস্পষ্ট হবে। তখন অর্থ দাঁড়াবে, কোত্থেকে তোমার জন্য এটা? বল্লেন, এটা থেকে নিকট আল্লাহর।

অনুবাদের ধরণ           উদাহরণ-২                          উদাহরণ-১

ك حال كيف ك اسم ما  শাব্দিক আপনার অবস্থা কেমন তোমার নাম কি
ভাবানুবাদ শাব্দিকঃ আপনি কেমন আছেন? তোমার নাম কি?
অনুবাদের ধরণ উদাহরণ-৩ الله عند من هو قالت هذا لكِ أني مريم يا قال  শাব্দিক আল্লাহর নিকট  থেকে সে বল্লেন এটা তোমার জন্য কোত্থেকে মারয়াম হে বল্লেন
ভাবানুবাদ শাব্দিকঃ  তিনি বল্লেন, হে মারয়াম, তোমার জন্য এটা কোত্থেকে এলো। তিনি বল্লেন, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে
ভাবানুবাদ ব্যাখ্যামূলকঃ যাকারিয়্যা আ. বল্লেন, হে মারয়াম, তোমার জন্য এ খাবার কোত্থেকে এলো? এারয়াম আ. বল্লেন, এ খাবার আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এসেছে।

 

অনুবাদের শর্তসমূহ:
অনুবাদ বলতেই বুঝা যায় যে এক ভাষা হতে অন্য ভাষায় ভাষান্তর। অতএব যিনি অনুবাদ করবেন তাঁকে একাধিক ভাষা জানতে হবে। শুধু জানলেই হবে না, তাঁর মাঝে থাকতে হবে কিছু শর্ত এবং তার প্রতিফলন ঘটবে অনুবাদে। যেমন:
১. অনুবাদের জন্য অবশ্যই একজন অনুবাককে হতে হবে মূল ও অনূদিত উভয় ভাষায় দক্ষ।
২. উভয় ভাষার উসলূব (ব্যবহার শৈলী বা পদ্ধতি) ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে থাকতে হবে প্রচুর জ্ঞান।
৩. অনুবাদে মূল ভাষায় ব্যবহৃত শব্দাবলীর ব্যবহার, অর্থ ও উদ্দেশ্যেও পূর্ণ প্রতিফলন থাকতে হবে।
৪. অনুদিত ভাষা হতে হবে মূল ভাষা হতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যাতে কওে এক ভাষার কথা বা ভাব অন্য ভাষায় প্রতিস্থাপিত হতে পারে। (মানাহিলুল ইরফান:খ-২, পৃ-১১৩)
কুরআন পরিচিতি:
কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কালাম। কুরআন আল্লাহ তা‘আলার কিতাব। আল্লাহ পাক জিব্রীল আমীনের মাধ্যমে প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিকট নাযির করেছেন এ মহান কিতাব আল কুরআন। আরবী ভাষায় নাযিল করা হয়েছে এ কিতাব।
কুরআনের ভাষায় কুরআন পরিচিতি:
১. ذلِكَ ٱلۡكِتَـٰبُ لَا رَیۡبَۛ فِیهِۛ هُدى لِّلۡمُتَّقِینَ ‘এ এক মহান কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই।’ (সূরা বাকারা:২)
২. تَنزِیلُ ٱلۡكِتَـٰبِ لَا رَیۡبَ فِیهِ مِن رَّبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ‘নাযিলকৃত এক মহান কিতাব। এ কুরআন যে রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে (নাযিলকৃত) তাতে কোন সন্দেহ নেই।’ (সূরা আলিফ লাম মীম সাজদাহ:২)
৩. وَإِنَّهُۥ لَتَنزِیلُ رَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ۝١٩٢ نَزَلَ بِهِ ٱلرُّوحُ ٱلۡأَمِینُ ۝١٩٣ عَلَىٰ قَلۡبِكَ لِتَكُونَ مِنَ ٱلۡمُنذِرِینَ ۝١٩٤ بِلِسَانٍ عَرَبِیّ مُّبِین ‘এ কুরআন তো বিশ্ব জাহানের পালনকর্তার নিকট থেকে অবতীর্ণ। আপনার অন্তরে তা নিয়ে এসেছেন জিব্রীল আমীন…সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়।’ (সূরা শু‘আরা:১৯২-১৯৫)
৪. إِنَّاۤ أَنزَلۡنَـٰهُ قُرۡءَ ا نًا عَرَبِیّا لَّعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ‘ধামি একে আরবী ভাষায় কুরআনরূপে নাযিল করেছি।’ (সূরা ইফসুফ:২)
৫. قُرۡءَانًا عَرَبِیًّا غَیۡرَ ذِی عِوَج لَّعَلَّهُمۡ یَتَّقُونَ ‘আরবী এ কুরআন বক্রতামুক্ত যাতে (এর উপর আমল করে) তারা মুত্তাকী হতে পারে।’ (সূরা যুমার:২৮)
কুরআনের অনুবাদ:
কুরআন নাযিল করা হয়েছে বিশ্ব মানবতার হিদায়াতের জন্য। আর এ জন্যই কুরআনকে সহজ করে দেওয়া হয়েছে। সহজ করে দেওয়া হয়েছে এর পঠনপাঠন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন- وَلَقَدۡ یَسَّرۡنَا ٱلۡقُرۡءَانَ لِلذِّكۡرِ فَهَلۡ مِن مُّدَّكِر ‘(শপথ) অবশ্যই আমরা নিশ্চিতভাবে কুরআনকে (তিলাওয়াত ও বুঝার জন্য) সহজ করে দিয়েছি। অুঃপর আছে কি কেউ চিন্তশীল বা উপদেশ গ্রহণকারী? (সূরা কামার:১৭,২২,৩২,৪০)
অতএব কুরআনের বাণী ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বময়। আর এর জন্য প্রয়োজন বিশ্বের সকল ভাষায় কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীর। শুধু আরবী ভাষায় কুরআনের হিদায়াত ও পয়গাম সিমাবদ্ধ থাকবে তা তো হতে পারে না। এ প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বহু পরে হলেও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় কুরআন অনুবাদের সূচনা হয়
(ড. মুজীবুর রহমান কৃত বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা:পৃ-৩+)
বাংলাভাষা এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলা ভাষায় শুরু হয় এর চর্চা। সে অনুবাদের কাতারে অংশ নেয় অমুসলিমরাও।
কুরআনের অনুবাদ হবে কোন ধরনের?
কুরআনের শাব্দিক বা আক্ষরিক অনুবাদ কি সম্ভব? এ প্রসঙ্গে রয়েছে দ্বিমত। আমরা ‘না’ এর পক্ষে। ভাবানুবাদেই কুরআনের যথাযথ অনুবাদ সম্ভব নয়। তো কুরআনের ই’জাযসহ সব কিছু ঠিক রেখে আক্ষরিক বা শাব্দিক অনুবাদ কি করে সম্ভব? যথাযথভাবে কুরআনের অনুবাদ যে সম্ভব নয় তা মেনে নিয়েছেন সাহিত্য বিশারদগণ। কুরআন কারীমের ইংরেজী অনুবাদক মার্মডিউক পিকথল এর প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঞযব কড়ৎধহ পধহহড়ঃ ঃৎধহংষধঃবফ ….ওঃ (ঊহমশরংয ঃৎধহংষধঃরড়হ) পধহ হবাবৎ ঃধশব ঢ়ষধপব ড়ভ কড়ৎধহ রহ অৎধনরপ, হড়ৎ রং সবধহঃ ঃড় ফড় ংড়’
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘শুরআন মাজীদের অনুবাদ যে ভাষাতেই হোক না কেন অসম্ভম। তবে অনুবাদে মূলের কিছুটা ছায়া দেওয়া যাইতে পারে। নূরজাহানের ছায়াতে কি নূর থাকতে পারে? কুরআন তো আল্লাহর কালাম, কিন্তু সাধারণ আরবী ভাষায়ও এমন শব্দ আছে, যাহার ঠিক প্রতিশব্দ বাংলায় দেওয়া দুঃসাধ্য।
অতএব বলা যায় কুরআনের অনুবাদ হবে ভাবানুবাদ। ভাবানুবাদঃ শাব্দিক ও ভাবানুবাদঃ ব্যাখ্যামূলক দুটোই হতে পারো। ভাবানুবাদঃ সংক্ষিপ্ত, এটা কুরআনের ক্ষেত্রে না করাই ভাল। তবে আলোচনার সুবিদার্থে কোন সূরার সারসংক্ষেপ করা যেতে পারে।
কুরআনুল কারীমের অনুবাদের জন্য যা জানা প্রয়োজন:
কুরআনুল কারীম যেহেতু আল্লাহর কালাম আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে তাই কুরআনের সঠিক ও বিশুদ্ধ অনুবাদের জন্য সহায়ক কিছু বিষয় সম্পর্কে অবগতি থাকতে হবে। তাফসীরের ক্ষেত্রেও এগুলো প্রজোয্য। অন্যথায় কুরআনের অনুবাদে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ জন্য যে মৌলিক বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন তা নিম্নরূপ:
১. বিশুদ্ধ আকীদা।
২. অনুবাদের উৎসসমূহ। যথা:
ক. কুরআন।
খ. হাদীস ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাত।
গ. সাহাবায়ে কিরামের বক্তব্য।
ঘ.তাবেয়ীগণের বক্তব্য।
৩. উলূমুল কুরআন। যথা:
ক. ইলমুল ক্বিরাআত।
খ. ইলমুল নাসিখি ওয়াল মানুসূখ।
গ. ইলমু আসবাবিন নুযূল।
ঘ. মাক্কী ও মাদানী।
৪. উলূমুল লুগাত। যথা:
ক. ইলমু মাআনিল কালিমাত।
খ. ইলমুন নাহু ওয়াল ই‘রাব।
গ. ইলমুস সারফ।
ঘ. ইলমুল ইশতিক্বাক।
ঙ. ইলমুল বালাগাত।
৫. ইলমুল কাসাস ওয়াত তারীরখ
৬. উভয় ভাষার ব্যবহার পদ্ধতি।
কুরআনের অনুবাদ উপস্থাপনা:
অনুবাদ উপস্থাপনে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন: প্রথমতঃ শিক্ষক মহোদয় সরাসরি পাঠ উপস্থাপন করবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নিম্নে প্রদত্ত বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন।
১. নির্ধারিত আয়াত বা সূরা (যদি ছোট হয়) ব্লাক বোর্ডে লিখে নিতে হবে।
২. বিশুদ্ধভাবে শিক্ষক মহোদয় ছাত্রদের দারা পড়িয়ে নেবেন। প্রয়োজনে নিজেও পড়ে শোনাবেন।
৩. নির্ধারিত পাঠের শব্দার্থগুলো বলে দেবেন।
৪. জটিল শব্দ থাকলে সেগুলোর প্রয়োজনীয় তাহকীক (বাব, মূল অক্ষর, সীগা, জিনস, তা‘লীল, অর্থ ইত্যাদি) বলে দেবেন।
৫. ব্যকরণিক বিশ্লেষণ (ই‘রাব, তারকীব, মাফউলসমূহ, মাওসূফ-সিফাত-হাল ইত্যাদি) করে দেবেন।
৬. শানে নুযূল থাকলে তা বলে দেবেন।
৭. বালাগাতের কোন বিষয় থাকলে তা উপস্থাপন করবেন।
৮. এরপর একটি একটি আয়াতের অনুবাদ করবেন। অনুবাদ হতে হবে সচ্ছ ও প্রাঞ্জল ভাষায়।
দ্বিতীয়তঃ প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে অনুবাদ উপস্থাপন। এক্ষেত্রে করণীয়:
১. নির্ধারিত আয়াত বা সূরা (যদি ছোট হয়) ব্লাক বোর্ডে লিখে নিতে হবে।
২. বিশুদ্ধভাবে শিক্ষক মহোদয় ছাত্রদের দ্বারা পড়িয়ে নেবেন। প্রয়োজনে নিজেও পড়ে শোনাবেন।
৩. বাকী বিষয়গুলো এক এক করে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে উপস্থাপন করবেন।
৪. এরপর শিক্ষার্থীদের দ্বারাই অনুবাদের কাজ করিয়ে নেবেন।
৫. সবশেষে ক্ষিক্ষক মহোদয় নিজে প্রাঞ্জল ও সহজ ভাষায় অনুবাদ করে দেবেন।
শিক্ষাদান পদ্ধতিতে এ কৌশলটি অত্যন্ত কার্যকর। পাঠদানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ক্লাশকে প্রানবন্ত ও আকর্ষণীয় করে তোলে। এতে শিক্ষার্থীরা পুর্বেই পড়াশোনা করে আসবে এবং পড়াশোনায় উৎসাহ পাবে।
নমূনা অনুবাদ:
১. ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَـٰلَمِینَ ، ٱلرَّحۡمَـٰنِ ٱلرَّحِیمِ، مَـٰلِكِ یَوۡمِ ٱلدِّینِ.
১. শব্দার্থ: اَلْ অর্থ যদি তা جنس এর জন্য হয় তাহলে হবে ‘যাবতীয়’। আর যদি হয় استغراق এর জন্য তাহলে অর্থ হবে ‘সকল’। حمد এর অর্থ প্রশংসা। ل= জন্য, নির্ধারিত। رب=প্রতিপালক, পালনকর্তা, প্রভু। العالمين বহুবচন। এক বচনে عالَم। অর্থ ‘জগত’, ভাবার্থে ‘বিশ্ব’। الرحمن অত্যন্ত মেহেরবান। الرحيم =দয়ালু। مالك এ শব্দে রয়েছে একাধিক ক্বিরাআত। مَالِكِ، مَلِكِ। مالك=মালিক। مَلِكٌ = বাদশাহ, রাজাধিরাজ। يوم=দিন। الدين এ শব্দটির বেশ কয়েকটি অর্থ রয়েছে। এগুলোর কয়েকটি হলো, বিনিময়, হিসাব, নিকাশ, ইবাদাত, ইতাআত, হুকুম, বিধান, জীবন ব্যবস্থা ইত্যাদি। কিন্তু الدين এখানে يوم এর সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে বিনিময়, হিসাব নিকাশ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ভাবার্থে ‘বিচার’ ও ‘কিয়ামাত’।
২.ভাবানুবাদঃ শাব্দিক:
ক. সকল/যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি সকল সৃষ্টি জগতের প্রতিপালক। যিনি অত্যন্ত মেহেরবান দয়ালু। যিনি হিসাব নিকাশের দিনের মালিক/রাজাধিরাজ।
খ. সকল/যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি সারা বিশ্বের প্রভু। যিনি অত্যন্ত দয়াবান মেহেরবান। যিনি বিনিময় প্রদানের দিনের মালিক।
গ. বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য সকল/যাবতীয় প্রশংসা নির্ধারিত। যিনি অত্যন্ত মেহেরবান দয়ালু। যিনি বিচার/কিয়ামাতের দিনের মালিক/রাজাধিরাজ।
৩. ভাবানুবাদঃ ব্যাখ্যামূলক:
ক. সকল/যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর। (এখানে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, তিনি কে? কি তার পরিচয়? কেনইবা তাঁর জন্য সকল প্রশংসা নির্ধারিত? বা কেন তাঁর প্রশংসা করতে হবে? উত্তর, তাঁর রয়েছে অনেক গুনাবলী। একমাত্র তিনিই সকল প্রশংসার দাবিদার বা যোগ্য। কারণ,)
১. তিনি সকল সৃষ্টি জগতের প্রতিপালক/পালনকর্তা/প্রভু।
২. তিনি অত্যন্ত মেহেরবান।
৩. তিনি দয়ালু।
৪. তিনি হিসাব নিকাশ/বিনিময়/বিচার/কিয়মাতের দিনের মালিক/রাজাধিরাজ।
২. إِیَّاكَ نَعۡبُدُ وَإِیَّاكَ نَسۡتَعِینُ
১. শব্দার্থঃ إياك শব্দটি সর্বনাম। অর্থ ‘তোমারই’। ই‘রাবে শব্দটি مفعول। এর স্থান ক্রিয়াপদের পরে। কিন্তু ক্রিয়াপদের পূর্বে আসার কারণে আরবী ব্যকরন ও বালাগাতের নিয়মানুসারে (التقديم ماحقه التأخير يفيد الحصر) (এখানে কর্মটি তার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যাবে। এ জন্যই অনুবাদে ‘ই’ যোগ হয়ে একমাত্র বা শুধুমাত্র অর্থ হবে। نعبد কর্তাসহ ক্রিয়াপদ। বহুবচন মুতাকাল্লিম। عبادة ধাতু হতে নির্গত। অর্থ ‘আমরা ইবাদাত করি’। و = এবং। نستعين কর্তাসহ ক্রিয়াপদ। বহুবচন মুতাকাল্লিম। عون ধাতু হতে নির্গত। অর্থ ‘সাহায্য। বাবে استفعال থেকে হওয়ায় কাজটি প্রার্থনা করা বুঝাবে। অর্থ ‘ধামরা সাহায্য প্রার্থনা করি’।
২. ভাবানুবাদঃ শাব্দিক।
ক. আমরা তোমারই ইবাদাত করি এবং আমরা তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
খ. আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদাত করি এবং আমরা শুধুমাত্র তোমরই সাহায্য প্রার্থনা করি
৩. ভাবানুবাদঃ ব্যাখ্যামূলক।
ক. আমরা তোমারই ইবাদাত করি (অর্থাৎ আমাদের সকল/যাবতীয় ইবাদাত তোমারই জন্য নিবেদিত। সকল ধরনের সাহায্য করার ক্ষমতা একমাত্র তোমারই আছে। তাই) আমরা তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।
খ. আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদাত করি (অন্য কারো ইবাদাত করি না।) এবং আমরা শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। (অন্য কারো সাহায্য করার ক্ষমতা নাই। তাই অন্য কারো নিকট সাহায্য কামনা করি না।) এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো যদি এভাবে বলা হত نَعۡبُدُ وَ نَسۡتَعِینُكَ তাহলে অর্থ দাড়াত, আমরা তোমার ইবাদাত করি এবং তোমার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি। এতে করে অন্য কারো ইবাদাত না করা বা অন্য কারো নিকট সাহায্য না চাওয়া দৃঢ়ভাবে বুঝা যায় না। যা বুঝা যায় তা হলো, আমরা যেমন আপনার ইবাদাত করি তেমনিভাবে অন্য কারোও ইবাদাত করতে পারি।। যেমন আপনার নিকট সাহায্য চাই তেমনিভা অন্য কারো নিকট সাহায্য চাইতে পারি। কিন্ত যখনি বলা হলো, ‘ধামরা একমাত্র তোমারই ইবাদাত করি এবং আমরা শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি’ তখন আর কারো ইবাদাত করে বা অন্য কারো কাছে সাহায্য চাওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। ইবাদাত এশমাত্রআল্লাহর জন্যই নিদৃষ্ট করে দেওয়া হলো। অন্য কারো কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে না।
৩. عَبَسَ وَتَوَلَّىٰۤ ۝١ أَن جَاۤءَهُ ٱلۡأَعۡمَىٰ ۝٢ وَمَا یُدۡرِیكَ لَعَلَّهُۥ یَزَّكَّىٰۤ ۝٣ أَوۡ یَذَّكَّرُ فَتَنفَعَهُ ٱلذِّكۡرَىٰۤ ۝٤ أَمَّا مَنِ ٱسۡتَغۡنَىٰ ۝٥ فَأَنتَ لَهُۥ تَصَدَّىٰ ۝٦ وَمَا عَلَیۡكَ أَلَّا یَزَّكَّىٰ ۝٧ وَأَمَّا مَن جَاۤءَكَ یَسۡعَىٰ ۝٨ وَهُوَ یَخۡشَىٰ ۝٩ فَأَنتَ عَنۡهُ تَلَهَّىٰ ۝١٠ كَلَّاۤ إِنَّهَا تَذۡكِرَةࣱ ۝١١ فَمَن شَاۤءَ ذَكَرَهُۥ ۝١٢ (সূরা আবাসা:১-১২)
৩.১. শব্দার্থ
৩.২. শানে নুযূল
৩.৩. ১. বালাগাতঃ ইলতিফাত. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মানার্থে সরাসরি সম্মোধন না করে প্রথমে غائبএর ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে। পরে ব্যবহার করা হয়েছে حاضر এর ক্রিয়াপদ।
৩.৩.২. আরবী ব্যকরনিক নীতিমালা وَأَمَّا مَن جَاۤءَكَ یَسۡعَىٰ ، وَهُوَ یَخۡشَىٰ .
৩.৩.৩. আরবী শব্দের ব্যবহারবিধি له تصدى، وما عليك، عنه تلهى، كلا
৩.৪. ভাবানুবাদঃ শাব্দিক

ড. হাফেজ এ. বি. এম. হিজবুল্লাহ
সহযোগী অধ্যপক
আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

চলমান পোষ্ট

মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।

সর্বশেষ পোস্ট

শীর্ষ লেখক

সর্বাধিক মন্তব্য

বৈশিষ্ট্যযুক্ত ভিডিও

ক্যাটাগরি