উলূমুল কুরআন বিষয়ক কিতাব পরিচিতি

উলূমুল কুরআন বিষয়ক কিতাব পরিচিতি
শাস্ত্রকারে উলূমুল কুরআন বিষয়ক গ্রন্থাবলীর পরিচিতিমাওলানা জাহিদুল ইসলাম

শাস্ত্র আকারে উলূমুল কুরআন বিষয়ক গ্রন্থসমূহের পরিচিতি: ১. ফুনূনুল আফনান ফী উয়ূনি উলূমিল কুরআন: উলূমুল কুরআন বিষয়ক প্রাচীনতম একটি কিতাব হলো فنون الأفنان في عيون علوم القرآن । উপরোক্ত কিতাবটি রচনা করেছেন আবুল ফারজ জামালুদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনুল জাওযী। ফুনূনুল আফনান ফী উয়ূনি উলূমিল কুরআন: লেখক পরিচিচি: ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. আব্বাসী খিলাফার শাসনামল (৬৩৬-৬৫৬

শাস্ত্র আকারে উলূমুল কুরআন বিষয়ক গ্রন্থসমূহের পরিচিতি:

১. ফুনূনুল আফনান ফী উয়ূনি উলূমিল কুরআন:

উলূমুল কুরআন বিষয়ক প্রাচীনতম একটি কিতাব হলো فنون الأفنان في عيون علوم القرآن ।
উপরোক্ত কিতাবটি রচনা করেছেন আবুল ফারজ জামালুদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনুল জাওযী।

ফুনূনুল আফনান ফী উয়ূনি উলূমিল কুরআন:

লেখক পরিচিচি: ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. আব্বাসী খিলাফার শাসনামল (৬৩৬-৬৫৬ হি.) এর শেষের দিকে ষষ্ঠ শতাব্দীর শুরুর দিকে জন্ম লাভ করেছেন এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে ৫৯৭ হিজরীতে ইন্তেকাল করেছেন।
তিনি হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. এর বংশ পরম্পরা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এর বংশের সাথে মিলিত হয়।

ইবনুল জাওযী নামকরণের কারণ:
তাঁর পূর্ব পূরুষদের নবম পুরুষ ‘জাফর বিন আব্দিল্লাহ’ এর সাথে সম্পৃক্ত করে তাঁকে ‘ইবনুল জাওযী বলা হয়। ইবনু দাহিয়্যা রহ. বলেন, মূলত ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. এর পূর্ব নবম পুরুষ ‘জাফর বিন আব্দিল্লাহ’ তিনিই হলেন জাওযী। তাঁর এলাকায় শুধুমাত্র তাঁর বাড়ীতেই একটি আখরোট গাছ ছিল এছাড়া আর কারো বাড়ীতে ছিল না এজন্য তাকে উক্ত আখরোট গাছের দিকে সম্পৃক্ত করে জাওযী এবং তার দিকে সম্পৃক্ত করে মুসান্নিফ রহ. কে ইবনুল জাওযী বলা হয়।
শৈশব: ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. বলেন, আমি অবুঝ থাকা অবস্থায় আমার পিতা ইন্তেকাল করেন আর আমার মাতাও আমার প্রতি পরিপূর্ণ যত্নবান ছিলেন না। আমার মায়ের ভাষ্যমতে ৫১৪ হিজরীতে আমার পিতা ইন্তেকালের সময় আমার বয়স ছিল তিন বৎসর।
শৈশব ও শিক্ষার সূচনা:
ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. ইয়াতিম অবস্থায় ফুফুর প্রতিপালনে বেড়ে ওঠেন। তিনি তাঁকে আবুল ফজল বিন নাসের এর মসজিদে নিয়ে যান।
আল্লাহ তা‘আলা আবুল ফজল বিন নাসের রহ. এর অন্তর ইবনুল জাওযী রহ. এর প্রতি আকৃষ্ট করে দেন, ফলে তিনি তাঁর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন ও তার শিক্ষা দীক্ষার প্রতি বিশেষ খিয়াল রাখতে থাকেন।

অন্যদিকে ইবনুল জাওযী রহ. ও তাঁর সম্মান, মর্যাদা ও অনুগ্রহের বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, তিনিই আমার হাদীস শোনানোর যিম্মাদারী গ্রহণ করেছেন। ফলে আমি মুসনাদে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল তার পাঠে শুনেছি এবং মুসনাদে আহমাদ বিন হাম্বল ছাড়া বৃহদাকৃতির ও বহু খন্ডের অনেক কিতাব অন্যান্য শায়খদের থেকে শুনেছি। আর আমি অন্য শায়খদের থেকে যা শুনেছি তিনি আমাকে সেগুলো ঠিক করে দিতেন।

তিনি হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। তিনি সময় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় সাধারণ মানুষের সংশ্রব থেকে পৃথক থাকতেন। মানুষের সাথে সাধারণত দরস প্রদান ও ওয়াজ করার প্রয়োজনে মিশতেন। তিনি সকল শ্রেণীর মানুষের সামনে সত্য প্রকাশে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিলেন।

ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. এর আসাতিযা:
১. আবুল ফজল মুহাম্মদ বিন নাসের বিন মুহাম্মাদ বিন আলী বিন উমার। (৫৫০হি.)
২. আবুল হাসান আলী বিন উবাইদুল্লাহ বিন নাসর আস র্সিরী। (৫২৭হি.) শৈশবে তাঁর থেকে কুরআন কারীম শিখেছেন।
৩. আব্দুল ওয়াহ্হাব মুবারক বিন আহমাদ বিন আল-হাসান আল-আনমাতী। (৫৩৮হি.)
৪. আবু মানসুর আল-জুয়ালীকী। (৫৪০ হি.)
আল্লামা শামসুদ্দীন মুহাম্মদ বিন আহমাদ যাহাবী তাঁর প্রশংসা করে বলেন, আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযী রহ. ছিলেন তাফসীর বিষয়ে সমুদ্র, সিয়ার ও ইতিহাস বিষয়ে আল্লামা, সুন্দর ও সাবলিল ভাষায় কথা বলতেন, বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান রাখতেন এবং তিনি ফক্বীহ ছিলেন।

বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর অনেক রচনাবলীর মাঝে তাফসীর ও উলূমুল কুরআন সংক্রান্ত কিতাব:
তিনি বিশাল এক তাফসীর রচনা করেছেন যার নাম দিয়েছেন ‘আল-মুগনী। মধ্যম পর্যায়ের এক তাফসীর রচনা করেছেন তার নাম দিয়েছেন ‘যাদুল মাসীর’। সংক্ষিপ্ত এক তাফসীর রচনা করেছেন তার নাম দিয়েছেন ‘তাইসীরুল বায়ান’ এবং ‘গারীবুল কুরআন’ বিষয়ে এক তাফসীর রচনা করেছেন তার নাম দিয়েছেন ‘তাযকিরাতুল আরীব ফী তাফসীরিল গারীব’। ইবনুল জাওযী রহ. বলেন, আমার আশা তাফসীরের এ সমষ্টি তাফসীরের অন্য কিতাব থেকে যথেষ্ট হয়ে যাবে। এছাড়া তাফসীর ও উলূমুল কুরআন বিষয়ে তার আরো রচনা:
১. تفسير الفاتحة ।
২. التلخيص
৩. غريب الغريب।
৪. نزهة العيون النواظر في الوجوه والنظائر।
৫. الوجوه النواظر في الوجوه والنظائر (وهذا ملخص لسابقه ويتضمن آيات مفسرة في مجالس الوعظ ونظائرها.।
৬. أسباب النزول (في أسباب النزول) ।
৭. الإشارة إلى القراءة المختارة
৮. كتاب السبعة في قراءات السبع
৯. تذكرة المنتبه في عيون المشتبه، في القرآءات
১০. عمدة الراسخ في معرفة المنسوخ والناسخ/نواسخ القرآن
১১. المجتبى في علوم القرآن
১২. المجتبى من المجتبى. (وهو مختصر لسابقه)
১৩. فنون الأفنان في عيون علوم القرآن
১৪. عجائب علوم القرآن (وهو نفس سابقه باستثناء أبحاث كأنها نزعت منه اختصارا. وستجد في دراسة النسخ المخطوطة بيانا وافيا بإذن الله)
১৫. مختصر فنون الأفنان في علوم القرآن
১৬. رد الأغصان في فنون الأفنان. (ولعله نفس المنختصر السابق.)

ফুনূনুল আফনান ফী উয়ূনি উলূমিল কুরআন:
কিতাব পরিচিতি:
ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. উলূমুল কুরআন এর এ কিতাবটি সাত দিনে লিখে সমাপ্ত করেছেন। ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. এর রচনাবলী যুগ যুগ ধরে মূল উৎস হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আসছে। আহলে ইলম ও তালিবুল ইলমগণ তার কিতাব থেকে উপকৃত হয়ে আসছেন।

ইমাম সূয়ূতী রহ. স্বরচিত কিতাব আল-ইতকান ফী উলূমিল কুরআন এর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ইবনুল জাওযী রহ. এর কিতাব ‘আন-নাফীস, ফুনূনুল আফনানসহ অন্যান্য কিতাব থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন।

ফুনূনুল আফনান এর উৎস:
ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. তার কিতাব রচনায় পূর্ববর্তীদের কিতাবের উপর নির্ভর করেছেন। যেমন আবু বকর মুহাম্মদ বিন কাসেম আল-আম্বারী। আবুল হুসাইন আহমাদ বিন জা‘ফর আল-মা‘রুফ বি-ইবনিল মুনাদী (৩৩৬ হি.)। আবু মানসূর মাওহুব বিন আহমাদ আল-জুওয়ালীকী (৪৫০ হি.)

এছাড়াও আরো অনেকের কিতাব থেকে নিজ কিতাবে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। পরবর্তী উলামায়ে কেরাম তার কিতাবকে মা‘খায বানিয়েছেন যেমন আল্লামা সূয়ূতী রহ. কয়েক যুগ পরেও নিজ কিতাব ‘আল-ইতক্বান ফী উলূমিল কুরআনে’ বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করেছেন।

ফুনূনুল আফনান ফী আজায়িবি উলূমিল কুরআন:
উলূমুল কুরআন বিষয়ক প্রচীনতম একটি কিতাব হলো فنون الأفنان في عجائب علوم القرآن ।

উপরোক্ত কিতাবটি রচনা করেছেন আবুল ফারজ জামালুদ্দীন আব্দুর রহমান ইবনুল জাওযী।
উক্ত কিতাবটির ব্যাপারে কারো কারো মত হলো এ কিতাবটি ও পূর্বের কিতাবটি একই লেখকের।

২. আল-বুর হান ফী উলূমিল কুরআন:
উলূমুল কুরআন বিষয়ক উল্লিখিত কিতাবটি রচনা করেছেন, আল্লামা বদরুদ্দীন যারকাশী।

লেখক পরিচিতি:
নাম: মুহাম্মদ বিন বাহাদুর বিন আব্দুল্লাহ আয-যারকাশী।
উপণাম: আবু আব্দিল্লাহ।
উপাধী: বদরুদ্দীন।
আসাতিযা: তাঁর শায়খদের মাঝে ১. সিরাজুদ্দীন আল-বুলক্বীনী। ২.শিহাবুদ্দীন আল-আযরুয়ী। ৩. সালাহ উদ্দীন উমার বিন আমলীলাহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, তিনি কিতাবের মার্কেট ছাড়া সাধারণত কারো সাথে সাক্ষাত করতেন না; বরং নিজ বাড়িতে অবস্থান করতেন। আর যখন কোন লাইব্রেরীতে যেতেন তখন কিতাব ক্রয় করতেন না; বরং দিনের দীর্ঘ সময় কিতাবের দোকানে মুতালা‘আ করতেন এবং সাথে সব সময় কাগজ-কলম রাখতেন। দুর্লভ কিছু সংগ্রহ হলে তা বাড়িতে ফিরে স্বীয় রচনাবলীতে সংযোজন করতেন।

রচনাবলী:
তিনি বিভিন্ন বিষয়ের উপর অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচনাবলীর মাঝে কুরআন বিষয়ক নিম্নোক্ত দু’টি কিতাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১. আল-বুরহান ফী উলূমিল কুরআন।
২. তাফসীরুল কুরআন।

ওফাত:
তিনি দ্বীনে ইসলামের বিভিন্ন খিদমাত আঞ্জাম দিয়ে ৭৯৪ হিজরীর রজব মাসে রবিবার ইন্তেকাল করেন।

আল-বুর হান ফী উলূমিল কুরআন:
কিতাব পরিচিতি:
আল্লামা বদরুদ্দীন আয-যারকাশী রহ. বলেন, ‘উলূমুল কুরআন’ বিষয়টি যেহেতু সীমাবদ্ধ কোন বিষয় না এবং কুরআনী ইলমের কোন কুল কিনার নেই, এজন্য উলুমুল কুরআন বিষয়ে রচনা করতে সামর্থ অনুযায়ী মনযোগ কাজে লাগিয়েছি। এছাড়া ইলমে হাদীসের ন্যায় ইতিপূর্বের উলূমুল কুরআন বিষয়ক এমন কোন কিতাব সম্পর্কে আমি অবগত হয়নি, যে কিতাব উলূমুল কুরআন এর সকল বিষয়কে সমন্বয় করেছে। তাই আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহায্য কামনা করে এমন এক কিতাব রচনার কাজ শুরু করলাম, যা উলূমুল কুরআন বিষয়ে পূর্বের লোকদের উক্তিসমূহকে সমবেত করবে। আর আমি এ কিতাবের নাম নির্ধারণ করেছি ‘আল-বুরহান ফী উলূমিল কুরআন’।

আল্লামা বদরুদ্দীন যারকাশী রহ. আল-বুরহান ফী উলূমিল কুরআন কিতাবে, উলূমুল কুরআন এর সাতচল্লিশটি প্রকার উল্লেখ করেছেন। সর্বশেষ বলেছেন, উলূমুল কুরআন এর উল্লিখিত প্রকারগুলোর মধ্য হতে প্রত্যেকটি প্রকার এমন, যদি কেউ উক্ত প্রকারগুলোর কোন প্রকারের পুরাপুরি অনুসন্ধান করে সব সমন্বয় করতে চায়, তাহলে তার হায়াত শেষ হয়ে যাবে কিন্তু তার কাজ শেষ হবে না। তবে আমি প্রত্যেক প্রকারের মূল উসূলগুলোকে জমা করেছি এবং কোন কোন প্রকারের কিছু সুক্ষ্ম বিষয় জমা করেছি। কারণ উলূমুল কুরআন এর এ কাজ অনেক দীর্ঘ আর হায়াত অনেক ছোট। আমার অক্ষমতা দ্বারাও যদি মাকসাদ অর্জন হয় তাহলে সমস্যার কী আছে। কবি বলেন,
قالوا خذِ العَيْنَ من كلٍّ فقلتُ لهم* في العَين فضلٌ ولكنْ ناظر العَينِ
‘তারা বলে তুমি প্রত্যেক জিনিসের মূলকে ধারণ কর। অত:পর আমি তাদেরকে বললাম মূল জিনিসের মাঝেই শ্রেষ্ঠত্য রয়েছে। কিন্তু মূল জিনিসের দর্শক (সেটাকে অসম্পুর্ণ মনে করে) (সূত্র: আল-বুরহান ফী উলূমিল কুরআন এর ভূমিকা: ১৮, ২১)

৩. আল-ইতক্বান ফী উলূমিল কুরআন:
উলূমুল কুরআন বিষয়ক প্রসিদ্ধ ও সর্বমহলে পরিচিত একটি কিতাব হলো আল-ইতক্বান ফী উলূমিল কুরআন।
এ বিখ্যাত গ্রন্থটি সংকলন করেছেন তাফসীর ও হাদীছ শাস্ত্রের ইমাম আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ.।

লেখক পরিচিতি: রচনাকারীর নাম হলো আব্দুর রহমান বিন কামালুদ্দীন।
উপাধী জালালুদ্দিন কুনয়াত বা উপনাম আবুল ফজল নিসবাত সূয়ূতী বা সায়ূতী খুযাইরী, উসয়ূতী, তবে তিনি এলাকার দিকে সম্পৃক্ত করে সূয়ূতী বা সায়ূতী হিসাবেই অধিক পরিচিত।
মাত্র ৬ বৎসর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। এরপরই কুরআন কারীম হিফজ শুরু করেন এবং ৮ বৎসর বয়সে হিফজ সম্পন্ন করেন।

ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। তেমনিভাবে ইলম অর্জনের প্রতি ছিল তাঁর দারুণ আগ্রহ। এই অদম্য আগ্রহ নিয়ে কঠোর অধ্যবসায়ের ফলে তিনি নিজেকে বিশ^ বরেণ্য আলিম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। উলূমে ইসলামিয়ার এমন কোন পথ নেই, যে পথে আল্লামা সুয়ূতী রহ. বিচরণ করেননি। বহু শাইখের নিকট থেকে তিনি দুই লক্ষাধিক হাদীছ মুখস্থ করেছেন। আল্লামা সুয়ূতী রহ. হাদীছ, হাদীছের সনদ, আসমাউর রিজাল ও ইসতিমবাতে আহকামের ইলমের দিক দিয়ে তিনি সমকালীন যুগের সেরা ব্যক্তি ছিলেন।

ইলম অর্জনের নিয়মতান্ত্রিক ধারার পরিসমাপ্তির সাথে সাথেই প্রাপ্ত এই আমানতকে হকদারদের নিকট যথাযথভাবে পৌঁছানোর বিষয়ে উদ্যোগী হন এবং দরস-তাদরীস ও তাসনীফাতের মাধ্যমে দ্বীনী খিদমাত আঞ্জাম দানে নিজেকে মগ্ন রাখেন। এর ফলে একদিকে যেমন বহু যোগ্য শাগরিদ তৈরী করতে সক্ষম হন, তেমনিভাবে এর পাশাপাশি তাসনীফাতের মাধ্যমে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে পাঁচ শতাধিক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। বিশেষত: তাফসীর, উসূলে তাফসীর ও উলূমুল কুরআনসহ কেবল কুরআন বিষয়ে তিনি ৪৩ টি গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে কুরআন কারীমের তাফসীর ও ব্যাখ্যা-বিষয়েই ৫টি গ্রন্থ সংকলন করেন।
উল্লেখ্য যে, ফিকহী মাসায়িলের ক্ষেত্রে আল্লামা সুয়ূতী রহ. ইমাম শাফিঈ রহ. এর অনুসারী ছিলেন।
তিনি ৯১১ হিজরী মোতাবেক ১৫০৫ ঈসায়ীতে ইনতিকাল করেন।

আল-ইতক্বান ফী উলূমিল কুরআন:
কিতাব পরিচিতি:
কিতাব রচনার কারণ: আল্লামা সুয়ূতী রহ. উলূমুল কুরআন বিষয়ক রচিত কিতাবাদী মুতালা‘আ করে যখন দেখলেন যে শাস্ত্রীয় বিষয় হিসেবে কোন কিতাবই যথেষ্ঠ না, তখন তিনি ইচ্ছা করলেন ‘আল-ইতক্বান ফী উলূমিল কুরআন’ কিতাব রচনা করার।
সুয়ূতী রহ. এ কিতাবকে তাফসীর বিষয়ে স্বরচিত কিতাব “মাজমাউল বাহরাইন ওয়া মাতলাউল বাদরাইন” এর ভূমিকা হিসেবে রচনা করেছেন।

ইলমী বিবেচনায় আল-ইতক্বান ফী উলূমিল কুরআন এর মূল্যায়ন:
 আল-ইতকান ফী উলূমিল কুরআন কিতাবটি উলূমুল কুরআন বিষয়ক রচিত গ্রন্থসমূহের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব।

 ইমাম সুয়ূতী রহ. বলেন, আল্লাহ তা‘আলা চমৎকার ও দূর্লভ এ কিতাব রচনা, পূর্ণ করার তাওফীক দিয়ে আমার প্রতি অনেক অনুগ্রহ করেছেন। এ কিতাবে আমি এমন কিছু নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করেছি, যা পাঠকের জন্য কুরআন বুঝতে সহায়ক হবে। এমন কিছু নিয়ম-নীতি বর্ণনা করেছি যার সাহায্যে পাঠক কুরআনের মাকসাদ বুঝতে সক্ষম হবে। এমন কিছু ঘাটি স্থাপন করেছি যা পাঠকের জন্য কুরআনের রত্নভান্ডারের সকল রূদ্ধদার উন্মুক্ত করবে।

 এ কিতাবে রয়েছে জ্ঞানের (অর্থাৎ আকলগ্রাহ্য বিষয়াদির) সার নির্যাস। রিওয়াতের তরঙ্গ (রিওয়াতসমূহের বিপুল সমাবেশ)। সকল গ্রহণযোগ্য সঠিক তথ্য (উক্তিসমূহ)।

 এ কিতাবে আমি জ্ঞানগর্ভ বিভিন্ন বিষয়ের গ্রন্থসমূহকে মন্থন করে সেগুলোর সার-নির্যাস সংগ্রহ করেছি। আর বিপুল পরিমাণ তাফসীরের কিতাবাদি মুতালা‘আ করে সেগুলোর মূল বিষয়াবলী সন্বেবেশিত করেছি।

 কুরআনের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অতল সমুদ্রে ডুব দিয়ে মণি-মুক্তা কুড়িয়েছি। তার ধনভান্ডারের খনি খুঁড়ে তার স্বর্ণ-রূপার পিণ্ড বের করেছি এবং সেগুলো বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বিন্যস্ত করেছি। ফলে পাঠক তার থেকে এমন চমৎকার মণি-মুক্তা আহরণ করতে পারবে যা সংগ্রহ করতে অনেক কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখিন হতে হবে এবং প্রত্যেক আলোচনায় পাঠক এমন সব বস্তুর সমাহার দেখতে পাবে যা বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

আল্লামা সূয়ূতী রহ. বলেন, আমি ছাত্র যামানায় মুতাকাদ্দীমীনদের প্রতি খুবই বিস্মিত হয়েছি যে, ইলমে হাদীসের তুলনায় কেউ উলূমুল কুরআন নিয়ে কোন কিতাব রচনা করেনি। একপর্র্যায়ে আমি উস্তাযুল আসাতিযা, আল্লামা মুহীউদ্দীন কাফেজী রহ.কে বলতে শুনলাম যে, আমি ইলমে তাফসীর বিষয়ে এক কিতাব রচনা করেছি যা পূর্বে কেউ রচনা করেনি। তাঁর থেকে আমি কিতাবটি সংগ্রহ করেছি তো আমি দেখলাম তা আকৃতিতে একেবারেই ছোট। উক্ত কিতাবে দু’টি অধ্যায় রয়েছে।

এক অধ্যায়ে তাফসীর-তাবীল, কুরআন, সূরা ও আয়াত এর অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে কুরআন কারীমের ব্যাপারে রায় এর মাধ্যমে কথা বলার শর্তসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ একটি খাতেমা লেখা হয়েছে তাতে আলেম ও মুতাআল্লিম এর আদাব বর্ণিত হয়েছে। উক্ত কিতাবের মাধ্যমে আমার উলূমুল কুরআন বিষয়ক ইলমের তৃষ্ণা নিবারণ হলো না এবং আমার উদ্দেশ্য সফল হলো না। অতপর কাযিউল কুযাত, আলামুদ্দীন জালালুদ্দীন আল-বুলক্বীনী রহ. (মৃত:৮২৪হি.) আমাকে অবগত করলেন তাঁর রচিত ‘مواقع العلوم من مواقع النجوم ’ কিতাব সম্পর্কে।

উক্ত কিতাবটিকে আমি সুক্ষ্ম ও সুন্দর বিষয় সম্বলিত পেলাম। আল্লামা জালালুদ্দীন বুলক্বীনী রহ. কিতাবের ভুমিকায় লিখেছেন, ইমাম শাফেয়ী রহ. থেকে প্রসিদ্ধ আছে যে তিনি আব্বাসী খলীফাদের কাউকে সম্বোদন করে বলেছেন, উক্ত সম্বোদন এর মাঝে রয়েছে উলূমুল কুরআন এর কিছু বিষয়ের আলোচনা। তিনি তা থেকে আমাদের বিষয় চয়নের ধারাকে গ্রহণ করেছেন।

উলামায়ে কেরামের এক জামাত উলূমুল হাদীসের সনদের উপর, মুসনাদ হাদীস ও হাদীস বিষেশজ্ঞদের নিয়ে কিতাব রচনা করেছেন। অথচ উলূমুল কুরআন ব্যাপক ও পরিপূর্ণ এবং স্বতন্ত্র একটি বিষয়। সুতরাং আমি ইচ্ছা করেছি আমার এ রচনায় আমি আমার সাধ্যনুযায়ী উল্লেখ করব এমন সব বিষয় নিয়ে আসতে, কুরাআন কারীম যে বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে। আর উক্ত বিষয়গুলো মৌলিকভাবে ছয়টি বিষয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ।
যথা:
أنواع علوم القرآن من كتاب “مواقع العلوم من مواقع النجوم”
১- مواطن النزول وأوقاته ووقائعه وفي ذلك إثنا عشر نوعا.
২- السند. وهوستة أنواع.
৩- الأداء. وهو ستة أنواع.
৪- الألفاظ. وهو سبعة أنواع.
৫- المعاني المتعلقة بالأحكام. وهو أربعة عشر نوعا.
৬- المعاني المتعلقة بالألفاظ، وهو خمسة أنواع.

চলমান পোষ্ট

মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।

সর্বশেষ পোস্ট

শীর্ষ লেখক

সর্বাধিক মন্তব্য

বৈশিষ্ট্যযুক্ত ভিডিও

ক্যাটাগরি