শিক্ষার জন্য শিক্ষকের বিকল্প আছে কি?

শিক্ষার জন্য শিক্ষকের বিকল্প আছে কি?
শিক্ষার জন্য শিক্ষকের বিকল্প আছে কি?মাওলানা জাহিদুল ইসলাম

শিক্ষার জন্য শিক্ষকের বিকল্প আছে কি? আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষকে অজ্ঞবস্থায় দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। এবং সকল নর-নারীর জন্য ইলম অর্জন ফরজ করেছেন। দুনিয়ায় আগমনের পর মানুষের জানা ছিল না যে, কোন কাজ কিভাবে করবে। কোন কাজ তার জন্য কল্যাণকর হবে ও কোন কাজ তার জন্য অমঙ্গল হবে। মানুষ যাতে ভাল-মন্দ বুঝতে পারে, ভূল-নির্ভূল পার্থক্য করতে

শিক্ষার জন্য শিক্ষকের বিকল্প আছে কি?

আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষকে অজ্ঞবস্থায় দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। এবং সকল নর-নারীর জন্য ইলম অর্জন ফরজ করেছেন। দুনিয়ায় আগমনের পর মানুষের জানা ছিল না যে, কোন কাজ কিভাবে করবে। কোন কাজ তার জন্য কল্যাণকর হবে ও কোন কাজ তার জন্য অমঙ্গল হবে।

মানুষ যাতে ভাল-মন্দ বুঝতে পারে, ভূল-নির্ভূল পার্থক্য করতে পারে, সে জন্য তাদের জন্য প্রয়োজন ছিল ইলম বা জ্ঞানের। ইলম এটা আল্লাহ তা‘আলার একটি সিফাত। আল্লাহ ত‘আলা তাঁর সৃষ্টির মাঝে একমাত্র মানব ও দানবকেই এ গুনে গুনান্বিত হওয়ার যোগ্যতা দান করেছেন।

মানুষ যাতে এ গুন অর্জন করতে পারে সেজন্য আল্লাহ তা‘আলা তিনটি মাধ্যম বা উপায় সৃষ্টি করেছেন।
১. শ্রবণ শক্তি।
২. দৃষ্টি শক্তি।
৩. বিবেক।
যখন এ তিন মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে কেউ চেষ্টা করবে তখন সে এর মাধ্যমে ইলমের গুনে গুনান্বিত হতে পারবে। ফলে অর্জন করতে পারবে সার্বিক কল্যাণ ও বর্জন করতে সক্ষম হবে সকল অকল্যাণ।

আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত জ্ঞানার্জনের তিন মাধ্যমের ব্যবহার পদ্ধতী:
মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞানার্জনের যে তিনটি জিনিস দিয়েছেন তার মাঝে প্রথম হলো শ্রবণ শক্তি।
মানুষ কোন বিষয় শ্রবণ করে তার মাঝে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়, চেষ্টা করে প্রত্যক্ষ করতে। সম্ভব হলে সেটাকে প্রত্যক্ষ করে। শ্রবণ করার পর দেখার দ্বারা বিষয়টি স্পষ্ট হয় কিন্তু কিছু বিষয় যেগুলো অস্পষ্ট থেকে যায় সেটার জন্য প্রয়োজন হয় বিবেকের মাধ্যমে চিন্তা করার।

যখন কেউ কোনকিছু শ্রবণ করে, দেখে ও চিন্তা করে তখনই কোন বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে। যদি এর ব্যতিক্রম হয়, যে শুনেই গ্রহণ করে ভুল না সঠিক চিন্তা করে না। যা দেখে তাই আমল করতে চায়, তহকীক করে না। তাহলে সঠিক বিষয়ে পৌঁছতে পারবে না। এজন্যই কোন জিনিস শ্রবণের পূর্বে চিন্তা করতে হবে কার নিকট থেকে শ্রবণ করব। কারণ সঠিক বিষয় শ্রবণের জন্য প্রথম চেষ্টা হতে হবে যার থেকে শ্রবণ করব তাকে নির্বাচন করা।

অনেক সময় যিনি শুনাবেন তার জানাই যদি সঠিক না হয় বা জানা সঠিক কিন্তু দুনিয়াবী কোন স্বার্থের কারণে তিনি সঠিকটি প্রকাশ করতে পারছেন না, তখন বাধ্য হয়ে তার থেতে বিভ্রান্তিকর বিষয়ই প্রকাশ পাবে। সেজন্য শ্রবণ করার পূর্বে যার থেকে শ্রবণ করব তাকে নির্বাচন করতে হবে। যেমন ইমাম মুসলিম রহ. মুসলিম শরীফের ভূমিকায় উল্লেখ করেন যে-
عن محمد بن سيرين قال: ان هذا العلم دين، فانظروا عمن تأخذون دينكم .
“হযরত মুহাম্মদ ইবনে সীরীন রহ. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নিশ্চয় এ ইলম, দ্বীন। সুতরাং তোমরা চিন্তা কর কার নিকট থেকে তোমরা তোমাদের দ্বীনকে গ্রহণ করবে।” এবং এবিষয়টিও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, যিনি কথা বলছেন বা আমি যার কথা শ্রবণের ইচ্ছা করছি তার ইলমের কোন সনদ আছে কি না? কারণ সনদ বা বর্ণনাসূত্র দ্বীনেরই অংশ। যেমনটি ইমাম মুসলিম রহ. মুসলিম শরীফের ভূমিকায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. এর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন-
عبدالله بن المبارك يقول : الاسناد من الدين ، ولولاالإسناد لقال من شاء ماشاء
“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. বলেন-হাদীস বর্নণাসূত্র দ্বীনেরই অংশ, যদি বর্নণাসূত্র না থাকত তাহলে (দ্বীনের ব্যাপারে) যার যা ইচ্ছা তাই বলত।”

অন্যদিকে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে- وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا ‘(হে মানুষ) তুমি যা জান না তার অনুস্মরণ কর না। নিশ্চয় শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি ও অন্তরসমূহ এর প্রত্যেকটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। (ইসরা-৩৬)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- وَهُوَ الَّذِي أَنْشَأَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيلًا مَا تَشْكُرُونَ “তিনিই সে সত্তা যিনি তোমাদের জন্য কর্ণ, চক্ষু ও অন্তকরণ: সৃষ্টি করেছেন। তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাক।” (মু‘মিনূন-৭৮)
আরো ইরশাদ হয়েছে- وَاللَّهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ “আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এ অবস্থায় ভূমিষ্ঠ করেছেন যে তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি ও হৃদয় যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।” (নাহল-৭৮)

আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত ইলম হাসিলের উল্লিখিত তিন মাধ্যম এর কৃতজ্ঞতা হবে এটাই যে এগুলোর সঠিক ব্যবহার করে আল্লাহ তা‘আলাকে চিনতে ও জানতে চেষ্টা করা। আল্লাহ তা‘আলার দ্বীন শিখতে, বুঝতে ও সে অনুযায়ী আমল করার ফিকির করা।

ইলম অর্জনের জন্য এ তিন মাধ্যম যথেষ্ট কি ?
আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক ব্যক্তিকে এপরিমাণ যোগ্যতা দান করেছেন যা সে কাজে লাগিয়ে স্রষ্টার সত্তা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের মাধ্যমে এবং কুরআনের ব্যাখ্যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীসের মাধ্যমে মানুষকে যে বিধি-বিধান ও নিয়ম-কানূন মেনে চলার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তা সকল মানুষের পক্ষে কুরআন-হাদীস থেকে বুঝে বের করা সম্ভব না। কারণ আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিভিন্ন কাজের যোগ্যতায় ভিন্নতা সৃষ্টি করেছেন। এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা কিছু লোককে কিছু লোকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন।

যেমন ইরশাদ হয়েছে- وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ “তিনিই সে সত্তা যিনি তোমাদেরকে ভূপৃষ্ঠের প্রতিনিধি করেছেন এবং তোমাদের একজনকে অপরজনের উপর মর্যাদায় উন্নিত করেছেন, তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তাতে পরীক্ষা করার জন্য।” (সূরা আন‘আম-১৬৫)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ
“তোমরা সে জিনিসের কামনা কর না যার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা একজনকে অপর জনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন।” (সূরা নিসা:৩২)

সুতরাং বুঝা গেল যে, চোখ, কান আর বিবেক ঠিক থাকলেই যথেষ্ঠ হবে না বরং আরো কিছু করনীয় রয়েছে।

কুরআন-হাদীস বুঝার যোগ্যতার দিকদিয়ে মানুষ দু’শ্রেণীর
১. যোগ্য।
২. অযোগ্য।

১. যাকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন-হাদীস অনুধাবন করার যোগ্যতা প্রদান করেছেন, সেই আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত দ্বীন সঠিকভাবে বুঝতে পারবে।
২. আর যাদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন সঠিকভাবে বুঝার যোগ্যতা প্রদান করা হয়নি তারা, যারা বুঝে তাদের থেকে শুনে শুনে আমল করবে।

কুরআ-সুন্নাহ বোঝার যোগ্যতা বিদ্যমান থাকাবস্থায়ও কিছু করণীয় রয়েছে:
যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা দ্বীন সঠিকভাবে বুঝার যোগ্যতা দিয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে নিয়ম হল তারা একা একা ব্যার্থ চেষ্টা না করে, কোন বিজ্ঞ উস্তাদের শরণাপন্ন হবে। কারণ যদি দ্বীন শিখতে উস্তাদের প্রয়োজন না হতো তাহলে আল্লাহ তা‘আলা শুধু কিতাব নাযিল করতেন, সেটার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বুঝাতে কোন রাসূল পাঠাতেন না। যেহেতু মানুষ যতই যোগ্যতা সম্পন্ন হোক, মেধাবী হোক, উস্তাদবিহীন জ্ঞানার্জন সম্ভব না। তাই আল্লাহ তা‘আলা কিতাব নাযিলের সাথে সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন সেটার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বুঝিয়ে দিতে, যাতে মানুষ সঠিকভাবে দ্বীন বুঝতে পারে। তদনুযায়ী আমল করতে পারে।

শুধু উস্তাদের নিকট শিক্ষা গ্রহণই যথেষ্ট নয়:
শুধু দ্বীন নয় দুনিয়ার কোন বিদ্যা ও জ্ঞানই উস্তাদ বিহীন শিক্ষা করা সম্ভব নয়। কোন বিষয়ে বিজ্ঞ হওয়ার জন্য যেভাবে বিজ্ঞলোককে উস্তাদ বানাতে হয়, তেমনিভাবে সে বিষয়ের কোর্স সম্পন্ন করাও অপরিহার্য। আমরা দুনিয়ার ক্ষেত্রে কেউ এ ভূল করি না যে, অসুস্থ হলে ডাক্তারী বই কিনে নিজে নিজেই চিকিৎসা করি। ভবন তৈরির জন্য ইঞ্জিনিয়ারের নিকট না গিয়ে বই ক্রয় করে নিজের ভবনের নকশা নিজেই তৈরি করি। কিন্তু দ্বীনের ক্ষেত্রে আমরা বিজ্ঞলোকের শরাণাপন্ন হওয়াকে শিরক মনে করি।

নিজেই সরাসরি কুরআন-হাদীস পাঠ করে আমলের দুঃসাহস দেখাই ও অপরকে এ কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করি।
উস্তাদের নিকট শিক্ষা করাও যথেষ্ট নয় বরং নিজে নিজে কুরআন-হাদীস বুঝার যোগ্যতা অর্জনের জন্য বিজ্ঞ উলামায়েকিরাম যে শর্ত উল্লেখ করেছেন সে সবগুলো যদি কোন ব্যক্তির মাঝে বিদ্যমান থাকে তাহলেই কোন ব্যক্তির জন্য কুরআন-হাদীস পাঠ করে এর ব্যাখ্যায় মতামত পেশ করা সঠিক হবে। অন্যথায় কেউ কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যায় মতামত পেশ করলে তাতে হিদায়াতের পরিবর্তে বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি পাবে।

বিজ্ঞ উলামা কর্তৃক কুরআন-হাদীসে পারদর্শী হওয়ার শর্তাবলী নিম্নরূপ:

১. ইলমুললুগাহ। (আরবী ভাষাজ্ঞান) কেননা এর দ্বারাই একক শব্দগুলোর অর্থ জানা যায়। হযরত মুজাহিদ রহ. বলেন:
لَا يَحِلُّ لِأَحَدٍ يُؤْمِنُ بِاللهِ وِالْيَوْمِ الْآخِرِ أَنْ يَتَكَلَّمَ فِىْ كِتَابِ اللهِ اِذَا لَمْ يَكُنْ عَارِفًا بِلُغَاتِ الْعَرَبِ
“আল্লাহ তা‘আলা ও পরকালে বিশ্বাসী কারো জন্য আরবী ভাষা জ্ঞান অর্জন করা ব্যতিত কিতাবুল্লাহ সম্পর্কে কথা বলা বৈধ নয়।

২. ইলমুননাহব। (আরবী ব্যকরণ শাস্ত্র) কেননা, ই‘রাবের পরিবর্তনে অর্থের মারাত্নক পরিবর্তন ঘটে আর ইলমুন নাহব জানার দ্বারা সেই ত্রুটি থেকে বেচে থাকা যায়। ড: মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ আবু শাহবাহ, প্রখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে রূহুল মা‘আনীর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেন যে, ইলমুননাহব না জানার ফলে এমন মারাত্নক ভুলের সম্মুখীন হতে হয়, যা কখনো কুফরী পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।
এ ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য
قا ل الله تعالى : أَنَّ اللَّهَ بَرِيءٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ وَرَسُولُهُ
“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদের থেকে দায়মুক্ত।”
কিন্তু কেউ যদি وَرَسُولُهُ এর পরিবর্তে رَسُوْلِه তিলাওয়াত করে, তাহলে তিলাওয়াতকারী নিজের অজান্তেই কুফরীতে পতিত হবে। কারণ তখন আয়াতের অর্থ হবে “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের থেকে ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দায়মুক্ত” আর এ আয়াত সম্পর্কে এ ধরনের মারাত্নক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ইলমুন নাহব তথা আরবী ব্যকরণ শাস্ত্র উদ্ভাবনের সূত্রপাত হয়।

৩. ইলমুল ইশত্বিক্বাক। (মূলধাতু হতে শব্দগঠন শাস্ত্র) কেননা একই শব্দ যখন দুটি ধাতু হতে নির্গত হয়, তখন মূলধাতুর ভিন্নতার কারণে নির্গত শব্দের অর্থেও মারাত্নক পরিবর্তন সাধিত হয়। যেমন ‘মাসীহ্’ (হযরত ঈসা আ. এর একটি নাম) এ শব্দটি ‘সিয়াহাতুন’ ও ‘মাসহুন’ দুই ধাতু হতে উৎসারিত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। যদি ‘সিয়াহাতুন’ ধাতু থেকে উদগত হয় তাহলে মাসীহ অর্থ হবে অধীক ভ্রমনকারী। আর মাসহুন ধাতু থেকে নির্গত হলে অর্থ হবে কাউকে হাতের স্পর্শ দেয়া।

৪. ইলমুচ্ছরফ। (শব্দ গঠন ও রূপান্তর শাস্ত্র) অর্থাৎ এর দ্বারা শব্দের মূল রূপ সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। যেমন আল্লামা যামাখশারী রহ্: তার কৃত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে কাশ্শাফে” উল্লেখ করেছন যে, يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ “যেদিন আমি সকল মানুষকে তাদের আমলনামাসহ আহ্বান করব অথবা যেদিন আমি প্রত্যেক দলকে তাদের নেতা সহ আহ্বান করব। আয়াতের মাঝে উল্লিখিত اِمَامٌ শব্দটি সম্পর্কে এক শ্রেণীর লোক ধারনা পোষণ করে যে, এটা أُمٌّ এর বহুবচন। সে হিসাবে উক্ত আয়াতের অর্থ হয় সেদিন আমি সকল মানুষকে, সকল দলকে তাদের মাতা সহ আহ্বান করব, পিতা সহ নয়। এটা এমন অজ্ঞতা যা ইলমুচ্ছরফ না জানার কারনে সৃষ্টি হয়েছে। কেননা اُمٌّ এর বহুবচন امام ব্যবহার হয় না আর আল্লামা যামাখশারী রহ্: যথার্থই বলেছেন যে, এটা বিদ‘আতী তাফসীর।

৫. ইলমুল মা‘আনী। ও
৬. ইলমুল বয়ান। ও
৭. ইলমুল বদী‘। এ তিন প্রকার ইলমের সমষ্টি হচ্ছে ইলমুল বালাগাহ। কুরআনে কারীমের অলংকারিত্ব ও অলৌকিকত্ব বুঝার জন্য এর বিকল্প নেই।

৮. ইলমুল কিরাআহ্। এমন শাস্ত্র যার দ্বারা কুরআনী শব্দের উচ্চারণ পদ্ধতী জানা যায়। এবং এক ক্বিরাআতকে অন্য ক্বিরাআতের উপর প্রাধান্য দেয়ার সম্ভাব্য কারণ জানা যায়।
৯. ইলমু উসূলিদদ্বীন। তথা আক্বায়িদ শাস্ত্র যাতে মুফাসসির আক্বীদাগদ বিষয় ও শরীয়তের হুকুম আহক্বামের মাঝে এবং দ্বীনের মৌলিক বিষয় ও শাখা- প্রশাখাগত বিষয়ের মাঝে পার্থক্য করতে পারে এবং কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমান পেশ করতে পারে।

১০. ইলমুউসূলিল ফিক্বহ। (ফিক্বহের মূলনীতি বিষয়ক শাস্ত্র) এর দ্বারা কুরআন হাদীস হতে নির্গত আহক্বামের উপর দলীল-প্রমান পেশ করার পদ্ধতী সম্পর্কেও অবগত হওয়া যায়।

১১. ইলমু আসবাবিন নুযুল ওয়া-ইলমু ক্বসাসি ওয়াল আখবার। (কুরআন অবতরনের প্রেক্ষাপট ও ঘটনা-কাহিনী বিষয়ক জ্ঞান) কেননা কুরআন অবতরনের প্রেক্ষাপট জানার দ্বারা সহজে আয়াতের উদ্দেশ্য বুঝা যায়। আর ইলমুল ক্বাসাস জানার দ্বারা কোনটি ইয়াহুদী কর্তৃক বর্ণিত অণির্ভরযোগ্য ঘটনা, আর কোনটি সহীহ ও নির্ভরযোগ্য ঘটনা, উভয় প্রকার বর্ণনার মাঝে পার্থক্য করা যায়।

১২. ইলমুন নাসিখি ওয়াল মানসূখ (রহিত আয়াত ও রহিতকারী আয়াত বিষয়ক জ্ঞান)। এ বিষয়টি অর্জন করা মুফাসসিরের জন্য অত্যন্ত জরুরী। এটা না জানার কারনে মুফাসসিরকে মারাত্নক ভুলে নিপতিত হতে হয়।

১৩. ইলমুল ফিক্বহ (ফিক্বহ শাস্ত্র)। এর দ্বারা ফুক্বাহায়ে কিরামের মাযহাব জানা যায় এবং কুরআনী আয়াত বুঝার ও গ্রহন করার ক্ষেত্রে তাদের গৃহীত পদ্ধতী সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়।

১৪. ইলমুল আহাদীস। (হাদীস শাস্ত্র) এর দ্বারা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা সম্বলিত আয়াতের বিশ্লেষণ ও অস্পষ্ট বর্ণনা সম্বলিত আয়াতের অস্পষ্টতা দূরীকরণ সহ বিভিন্ন বিষয় জানা যায়।

১৫. ইলমুল মাওহিবাহ (আল্লাহ প্রদত্ত ইলম)। যে ব্যক্তি ইলম অনুযায়ী আমল করে তাকেই আল্লাহ তা‘আলা এই জ্ঞান দান করেন।
(আল ইতক্বান ফী উলূমিল কুরআন:৭৮নং অধ্যায়)
(আল ইসরাঈল্যিাত ওয়াল মাওযূআত লি আবি শাহবাহ: পৃ-৪৬৫)
(মানাযিলুল ইরফান ফী উলূমিল কুরআন: পৃ-২২৯)

মৌলিকভাবে উপরোক্ত বিষয়ের জ্ঞান ব্যতিত আরো কতিপয় বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা কুরআন-হাদীসে বিজ্ঞ হওয়ার জন্য আবশ্যক। উলূমুল কুরআনের গ্রন্থ সমূহে সেগুলোর বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

অপরিহার্য শর্তাবলী বাদ দিয়ে কুরআন-হাদীস বুঝার কিছু নমুনা:
১. আমরা জানি তাকলীদ হল কারো দ্বীনদারী, যোগ্যতা ও সততার প্রতি আস্থা রেখে তার পক্ষ থেকে কুরআন-সুন্নাহর সঠিক ব্যখ্যাগুলো মেনে নেয়া এবং তার নিকট দলীল-প্রমাণ না চাওয়া। কিন্তু যারা তাকলীদকে শিরক সাব্যস্ত করে তাদের এক বক্তা (আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসূফ সাহেব) এর দাবী যে, না জানলে জিজ্ঞেস করতে হবে দলীল-প্রমাণসহ। তিনি তার দাবীর স্বপক্ষে দলীল পেশ করলেন সূরা নাহলের আয়াত وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ (৪৩) بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ ।
তিনি এ আয়াতের অর্থ করলেন “যদি তোমরা না জান তাহলে জিজ্ঞেস কর। দলীল প্রমাণসহ।”

তার এ বিভ্রান্তিকর তরজমা শুনে মনে হয় তিনি আরবী গ্রামার পরিপূর্ণভাবে জানেন না, বা জানলেও সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারেননি। কারণ আয়াতের সঠিক অর্থ হল “আমি আপনার পূর্বে কেবল পুরুষদেরকেই রাসূলরূপে পাঠিয়েছি-যাদের নিকট ওহী প্রেরণ করতাম। সুতরাং যদি তোমরা না জান তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর। (সে নবীদেরকে প্রেরণ করেছি ) মু‘জিযা ও কিতাবসমূহ দিয়ে ।” দলীল-প্রমাণসহ জিজ্ঞেস কর এটি ভূল ও বিভ্রান্তিমূলক অনুবাদ।

২. একই ব্যাক্তি الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ এ আয়াতের তরজমা করলেন “যারা ভয়-ভীতি নিয়ে সালাত আদায় করবে।” সালাত আদায়ের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার একটি ভয়-ভীতি বিরাজ করবে যেটা হবে মানুষের সফলতার কারণ। তার এ তরজমা শুনে মনে হয় তিনি ইলমে ইশতিক্বাক জানেন না কারণ তিনি خَاشِعُونَ এর তরজমা করেছেন ভয়-ভীতি যা خ- ش-ع মূলধাতু হতে উদগত যার অর্থ বিনয় ও নম্রতা। আর ভয়-ভীতি অর্থে ব্যাবহৃত শব্দ হল خاشيون যা মূলত خ- ش – ي মূলধাতু থেকে উদগত।

৩. যারা তাকলীদকে শিরক সাব্যস্ত করে তাদের অনেকেই সূরা আন‘আম এর আয়াত إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ “নিশ্চয় যারা তাদের দ্বীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোন দায়িত্ব তোমার নেই।” এ আয়াত ও সূরা রূমের আয়াত وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ (৩১) مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا “তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না। যারা নিজেদের ধর্মকে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে এবং বহুদলে বিভক্ত হয়েছে।”

এর মাধ্যমে মাযহাব বা তাকলীদ এর অনুসারীদেরকে মুশরিক বলেন। লা-মাযহাবী ভাইয়েরা মাযহাবের ভিন্নতাকে তাফরীকে দ্বীন মনে করেন আর বিভিন্ন মাযহাবের অনুসারীদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত মনে করে তাদেরকে মুশরিক বলেন। তাদের এ বিভ্রান্তি, মূলত তাফরীক ও ইখতিলাফ শব্দের পার্থক্য ও দ্বীন শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা না জানার কারণে হয়েছে।

তাফরীক ও ইখতিলাফ শব্দের পার্থক্য
শায়খ মুহাম্মদ সালেহ আল-উসাইমীন কর্তৃক রচিত ‘তাফসীরুল কুরআনিল কারীম’ এর সূরা আলে ইমরানের ১০৩ নং আয়াতে উল্লিখিত ولاتفرقوا এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন যে, এ আয়াতের মাঝে তার্ফারুক ফীল কুলূব হারাম হওয়ার দলীল বুঝা যায়। সুতরাং কখনো কেউ যদি অবস্থান ও মতের দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয় তবুও জরুরী হল অন্তর সমূহ যেন বিচ্ছিন্ন না হয়।
যেমন হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে- لاتختلفوا فتختلف قلوبكم “তোমরা মতানৈক্য কর না, তাহলে তোমাদের অন্তরসমূহ বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে।” (সহীহ মুসলিম-৪৩২)

হযরত সাহাবায়ে কিরাম রা. এর ইজতিহাদী ইখতিলাফ কথার বিচ্ছিন্নতার মাঝেই সীমিত থাকত এবং তাদের অন্তর এক থাকত। মতের দিক দিয়ে পার্থক্য হলেও একে অপরকে অপছন্দ করতেন না। (তাফসীরুল কুরআনিল কারীম লি সালেহ আল-উসাইমিন:খ-২, পৃ:৩৩৯)

সুতরাং বুঝা গেল তার্ফরুক শব্দটির অর্থ বিক্ষিপ্ততা ও বিচ্ছিন্নতা হলেও বিশেষভাবে অন্তরের বিক্ষিপ্ততাই বুঝায়।
অন্যদিকে ইখতিলাফ শব্দটির ব্যাখ্যায় আল্লামা রাগেব আল-আস্ফাহানী মুফরাদাতুল কুরআন এর মাঝে উল্লেখ করেন যে, ‘ইখতিলাফ হল প্রত্যেক ব্যক্তির অবস্থা বা কথার দিক দিয়ে এমন পথ অবলম্বন করা যা অপর ব্যাক্তির পথের বিপরিত।’

শায়খ মুহাম্মদ আউওয়ামা ‘আদাবুল ইখতিলাফ ফী মাসায়িলিল ইলমি ওয়াদদ্বীন’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, ‘ইখতিলাফ হল পথ ও মত ভিন্ন হওয়া কিন্তু মাকসাদ বা গন্তব্যা এক হওয়া। ইখতিলাফ যা দলীলের ভিত্তিতে হয়।’ ইখতিলাফে মাযাহিবকে তাফরীকে দ্বীন যারা বলেন, তাদের হয়ত যথাযথভাবে আরবী ভাষা জ্ঞান নেই বা তারা তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারেন নি। কারণ আরবী ভাষায় তাফরীকে দ্বীন দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মৌলিকভাবে যে বিষয়গুলোকে দ্বীন বলা হয় সেগুলোর কিছু বিশ্বাস করা কিছু বিশ্বাস না করা। অথবা কোন বিষয় বাড়িয়ে দেয়া এবং কোন বিষয় কমিয়ে দেয়া। যেমন ‘কিতাবীরা’ করত। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন- أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَـٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضۚ
‘তোমরা কি কিতাবের কিছু (বিষয়) বিশ^াস কর, আর কিছু বিষয় প্রত্যাখ্যান কর। (সূরা বাকারা: ৮৫)

দ্বীন শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা
তাফসীরুল কুরআনের উৎসসমূহের মাঝে ১ম উৎস হল কুরআনে কারীমের এক আয়াতের তাফসীর অন্য আয়াতের মাধ্যমে করা। কারণ কুরআন কারীমের কোন শব্দ বা বাক্য এক স্থানে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয় এবং একই শব্দ ভিন্ন স্থানে একটু বিশ্লেষনসহ বর্ণিত হয়। সেক্ষেত্রে বিশ্লেষণমূলক আয়াতটি সংক্ষিপ্ত আয়াতের ব্যাখা হয়।
সূরা আন‘আমের ১৫৯ নং আয়াত إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ ও সূরা রূম এর ৩১ ও ৩২ নং আয়াত وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ (৩১) مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا এর মাঝে ব্যাবহৃত দ্বীন শব্দটি অস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এর দ্বারা কী উদ্দেশ্য তা অনুমেয় নয়। যার ব্যাখ্যা সূরা শুরার ১৩ নং আয়াতে একটু বিশ্লেষণসহ উল্লেখ হয়েছে।

সূরা শুরা এর ১৩ নং আয়াত- شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
“আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য দ্বীনের সে পথই বিধিবদ্ধ করেছেন যে পথের নির্দেশ দিয়েছিলেন হযরত নূহ আ. কে, আর আমি তোমার নিকট সে পথেরই ওহী প্রেরণ করি এবং আমি হযরত ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা আ. কেও সে পথের নির্দেশ দিয়েছিলাম যে, তোমরা দ্বীনকে কায়েম কর এবং দ্বীনের ব্যাপারে মতানৈক্য কর না।”

উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা হযরত নূহ আ. থেকে নিয়ে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সকলের দ্বীন এক ও অভিন্ন হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

সকল নবী ও রাসূলকে সে একই দ্বীন প্রচার করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু যেহেতু হযরত নূহ আ. প্রথম রাসূল আর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ রাসূল এবং মাঝে হযরত ইবরাহীম আ., মুসা আ., ও হযরত ঈসা আ. অধিক পরিচিত এ জন্য শুধু পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

সূরা আন‘আম ও সূরা রূমে উল্লিখিত দ্বীন শব্দটি অস্পষ্ট ছিল। এ আয়াত দ্বারা এতটুকু স্পষ্ট হল যে সকল নবী ও রাসূলের দ্বীন এক ও অভিন্ন ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হতে পারে যে, যদি সকল নবীর দ্বীন এক ও অভিন্ন হয়, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা নবী একজন প্রেরণ করলেইতো হত, তা না করে আল্লাহ তা‘আলা অন্যান্য নবী ও রাসূলদেরকে কেন প্রেরণ করলেন ? এ প্রশ্নটি হয়েছে মূলত দ্বীন শব্দটির ব্যাখ্যা না জানার কারণে। যাদের এ প্রশ্ন, তারা মনে করেছেন ইসলামী শরীয়তের সবকিছু তথা আকায়েদ, আ‘মাল এবং মৌলিক ও শাখাগত সকল বিধি-বিধানের সমষ্টিকে দ্বীন বলে! মূলত ইসলামী শরীয়াতের মৌলিক ও শাখাগত সকল বিধি-বিধানকে দ্বীন বলে না। কারণ যদি তা-ই হতো তাহলে সকল রাসূলের দ্বীন এক হওয়া সম্ভব নয়।

দ্বীন শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা কি ?
আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহ. তার কৃত তাফসীর তাফসীরে উসমানীতে সূরা শুরার ১৩ নং আয়াতে উল্লিখিত দ্বীন শব্দটির ব্যাখ্যায় বলেন- আসল দ্বীন সর্বদা এক ও অভিন্নই রয়েছে কেননা আকায়েদ, আখলাক ও উসূলে দিয়ানাত এর মাঝে সকল রাসূলের উম্মত একতাবদ্ধ থেকেছেন। সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম দ্বীন মৌলিকভাবে পাঁচটি জিনিসের সমন্বয়।

১. আকায়িদ। উসূলে দিয়ানাত তথা-
২. ইবাদাত।
৩. মু‘আমালাত।
৪. মু‘আশারাত। ও
৫. আখলাক।

এ পাঁচটি বিষয়ের উপর সর্ব যুগের সকল ঈমানদার লোকের আমল ছিল। সুতরাং যারা সূরা আন‘মের ১৫৯ নং ও সূরা রূমের ৩১ ও ৩২ নং আয়াত দ্বারা মাযহাবের অনুস্মরণকে শিরক বলেন তারা মূলত ইলমুললুগাহ তথা আরবী ভাষা জ্ঞান যথাযথভাবে না জানার কারণে বা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে না পারার কারণে এ ভূলের স্বীকার হয়েছেন।

৪. কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াত ও হাদীস এর ভাষ্য থেকে বুঝা যায় যে সব কাজ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই করতে হবে। উল্লিখিত বক্তব্যের আলোকে মতিউর রহমান মাদানী সা. হযরত শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ. কর্তৃক রচিত ফাযায়েলে আ‘মাল এর ভূমিকায় যে উক্তি রয়েছে ‘হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রহ. আমাকে তবলীগে দ্বীনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আয়াত ও হাদীস লিখে পেশ করতে আদেশ করেছেন। এরূপ বুযুর্গগণের সন্তুষ্টি হাসিল করা আমার মত গোনাহগারের জন্য গোনাহ-মাফী ও নাজাতের ওসীলা এই আশায় দ্রুত রচনা করতঃ এ কিতাবখানি পেশ করছি।”

এ উক্তিকে শিরক বলেছেন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা সকল কাজ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য করতে বলেছেন আর তিনি ফাযায়েলে আ‘মাল কিতাবটি রচণা করেছেন তাঁর শায়েখ হযরত মাওলানা ইলিয়াছ রহ. এর নির্দেশে তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য। এখানে মাদানী সাহেব ইলমুল বালাগাহ্ এর একটি কায়েদা ‘মাজাযে মুরসাল’ না বুঝার বা প্রয়োগ না করার কারণে এমনটি মন্তব্য করেছেন। অলংকার শাস্ত্রবিদদের নিকট ‘মাজাযে মুরসাল’ বলা হয় প্রতিবন্ধকতার কারণে কোন শব্দের নির্ধারিত বা আসল অর্থ উদ্দেশ্য নেয়া সম্ভব না হওয়া এবং শব্দটি সাদৃশ্যতা ছাড়া অন্য কোন সম্পর্কের কারণে ভিন্ন কোন রূপক অর্থে ব্যবহৃত হওয়া।
মাজাযে মুরসাল এর সম্পর্কগুলোর মাঝে অন্যতম হলো কোন জিনিসের সবাব উল্লেখ করে মুসাব্বাব উদ্দেশ্য নেয়া। যেমন কুরআনে কারীমে وَفِي السَّمَاءِ رِزْقُكُمْ “তোমাদের জীবিকা আসমানে রয়েছে।” অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-وَيُنَزِّلُ لَكُمْ مِنَ السَّمَاءِ رِزْقًا “আর তিনি তোমাদের জন্য আসমান থেখে জীবিকা নাযিল করেন” (সূরা মু‘মিন-১৩)

উল্লিখিত আয়াতে রিয্ক শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে কারণ আসমান থেকে জীবিকা অবতরণ হয় না। বরং আসমান থেকে জীবিকার উকরণ বৃষ্টি অবতরণ তথা বর্ষণ হয় যার মাধ্যমে যমীনে জীবিকা উৎপন্ন হয়। তেমনিভাবে শায়খ যাকারিয়া রহ. এর উক্তি “ হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রহ. আমাকে তবলীগে দ্বীনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আয়াত ও হাদীস লিখে পেশ করতে আদেশ করেছেন। এরূপ বুযুর্গগণের সন্তুষ্টি হাসিল করা আমার মত গোনাহগারের জন্য গোনাহ-মাফী ও নাজাতের ওসীলা এই আশায় দ্রুত রচনা করতঃ এ কিতাবখানি পেশ করছি।” বাহ্যিকভাবে শিরক মনে হলেও বাস্তবে তাতে র্শিক নেই। কারণ এ বাক্যে মাজাযে মুরসাল তথা মুক্ত রূপলংকার ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ Ñবাক্যটি আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির সবাব বা মাধ্যম যা উল্লেখ করা হয়েছে আর উদ্দেশ্য হল মুসাব্বাব তথা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি। আর উল্লিখিত বাক্যে নির্ধাতির অর্থ উদ্দেশ্য নেয়ার প্রতিবন্ধকতা হল, তিনি হচ্ছেন সর্বজন স্বীকৃত একজন খালেছ মুমিন ব্যাক্তি তিনি র্শিকযুক্ত কথা বলতে পারেন না। সুতরাং তাঁর কথাও শিরকযুক্ত হতে পারে না।

উল্লিখিত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে-

১. প্রত্যেক ব্যাক্তিকেই আল্লাহ তা‘আলা সরাসরি কুরআন-হাদীস থেকে মাসআলা বের করে আমল করার যোগ্যতা দেননি।

২. যাদেরকে এ যোগ্যতা দান করেছেন তারাও উস্তাদ বিহীন একা একা গবেষণা করে মূল লক্ষ্যপানে পৌঁছতে সক্ষম না।

৩. কেউ উস্তাদের নিকট থেকে শিখে যোগ্যতা অর্জন করলেও তার দিয়ানাতদারী-আমানাতদারী সম্পর্কে ভালভাবে না জেনে তাদের থেকে কুরআন হাদীস বিষয়ক কোন কথা গ্রহণ না করা। কারণ আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফাতিহার মাঝে তিন শ্রেণীর লোকের আলোচনা করেছেন।

১. মুন‘আম আলাইহি (যাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ রয়েছে)।

২. আল-মাগযূব আলাইহিম (যারা আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধে নিপতিত)।

৩. আয্যাল্লীন (পথ ভ্রষ্ট)। সূরা ফাতিহার মাঝে আল্লাহ তা‘আলা প্রথম শ্রেণীর লোকের পথ পাওয়ার জন্য, আর বাকি দুই শ্রেণীর লোক থেকে বেচে থাকার জন্য দু‘আ শিখিয়েছেন। যে দু’শ্রেণীর লোক থেকে বেচে থাকার দু‘আ শিখিয়েছেন তাদের এক শ্রেণী হল ‘আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধে নিপতিত’ এরা হল ইয়াহুদী অপর শ্রেণী হল ‘পথভ্রষ্ট’ এরা হল নাসারা।

শাইখুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমূদ হাসান রহ.‘তরজমায়ে শাইখুল হিন্দ’ এর মাঝে সূরা ফাতিহার আয়াত صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ এর তাফসীরে উল্লেখ করেন যে সিরাতে মুস্তাকীম থেকে বঞ্চিত থাকার মোট দু’টি কারন হতে পারে।

১. অজ্ঞতা-মূর্খতা।

২. বুঝে-শুনে সঠিক পথ থেকে সরে যাওয়া। কোন পথভ্রষ্ট ব্যাক্তি বা দল এ দু’কারনের বাহিরে পাওয়া যাবে না।

সুতরাং নাসারা-খৃষ্টানরা প্রথম কারন তথা অজ্ঞতার কারনে আর ইয়াহুদীরা দ্বিতীয় কারন তথা বুঝে-শুনে পথভ্রষ্ট।

অতএব কোন ব্যাক্তি বিজ্ঞ আলেম হয়েও স্বার্থের কারনে পথভ্রষ্ট হতে পারে। এ জন্য আমাদের উচিত হবে শুধু বাহ্যিক ইলমি যোগ্যতা নয়, সাথে সাথে তার ইলমী আমানাত ও দিয়ানাতদারীর প্রতিও বিচক্ষণতার সাথে লক্ষ্য রাখা কর্তব্য।

 

 

চলমান পোষ্ট

মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।

সর্বশেষ পোস্ট

শীর্ষ লেখক

সর্বাধিক মন্তব্য

বৈশিষ্ট্যযুক্ত ভিডিও

ক্যাটাগরি