পরিপূর্ণ দীনের চার উৎস

পরিপূর্ণ দীনের চার উৎস
পরিপূর্ণ দীনের চার উৎস-আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলীপুরী

গত ১১ নভেম্বর, সোমবার মুহাম্মদপুরস্থ বসিলা গার্ডেন সিটি মসজিদ সংলগ্ন মাঠে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়ার উদ্যোগে বার্ষিক ওয়াজ ও দু‘আর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

গত ১১ নভেম্বর, সোমবার মুহাম্মদপুরস্থ বসিলা গার্ডেন সিটি মসজিদ সংলগ্ন মাঠে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়ার উদ্যোগে বার্ষিক ওয়াজ ও দু‘আর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে দীনে ইসলামের পরিপূর্ণতা ও এর গ্রহণযোগ্য চারটি উৎস সম্পর্কে বয়ান পেশ করেন মুনাযিরে যামান, আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলীপুরী দা. বা.। বয়ানটির গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় আগ্রহী পাঠকের জন্যে তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। রেকর্ড থেকে বয়ানটির শ্রুতিলিখন করেছেন মা’হাদের ইফতা বিভাগের ছাত্র মৌলবী সুহাইল আহমাদ ও মৌলবী আবু তলহা মাসউদ। প্রয়োজনীয় কিছু পরিমার্জনার পর বয়ানটির শেষ অংশ আজ প্রকাশ করা হচ্ছে। -দারুত তাসনীফ

শেষ অংশ…

এখানে আরেকটি প্রশ্ন হয় মাযহাব বা মত তো অনেকগুলি। তাহলে কোনটি কুরআন-হাদীস অনুযায়ী আর কোনটি কুরআন-হাদীস বিরোধী?

একটি উদাহরণের মাধ্যমে এই প্রশ্নের জবাব দেবো।

কুরআনের সূরা বাকারার ২২৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنْفُسِهِنَّ ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ

অর্থ: তালাকপ্রাপ্তা নারীরা ভিন্ন স্বামী গ্রহণের আগে কিছু সময় অপেক্ষায় থাকবে।

কতদিন অপেক্ষা করবে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ

এই قُرُوء শব্দের দুইটি অর্থ আছে।

হায়েজ অবস্থার নাম- قُرُوء

পবিত্র অবস্থার নামও- قُرُوء

দেখা গেলো قُرُوء  শব্দের দুই অর্থ। একটা আরেকটার বিরোধী।

ইমাম শাফেয়ী রহ. পবিত্রতার অর্থ নিয়েছেন। ইমাম আবু হানিফা রহ. অপবিত্রতার অর্থ নিয়েছেন।

আপনারাই বলেন, এখানে কোনো মাযহাব কি কুরআন বিরোধী হয়েছে? নাকি দুই মাযহাবই কুরআন সাপেক্ষ হয়েছে? কারণ দু’ই মাযহাবের মূল বক্তব্যই তো কুরআনে আছে। তাহলে বুঝা গেলো কোন মাযহাব কুরআন বিরোধী না। প্রত্যেক মুজতাহিদের সমাধানই ইসলামী সমাধান বলে বুঝতে হবে।

সুতরাং যারা বলে, মাযহাব কুরআন বিরোধী এরা কুরআন, হাদীস বলতে কিছুই বুঝে না।

যুগশ্রেষ্ আলেমগণের ইজমা

ইজমার তৃতীয় স্তর হলো- যুগশ্রেষ্ঠ আলেমগণের ইজমা। যুগশ্রেষ্ঠ আলেমগণ ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আযান-ইকামতে, দীনী কাজে মাইক ব্যবহার করা যাবে।

ইজমা না থাকলে করণীয়

এখন যদি কোন বিষয়ের সমাধান কুরআন-হাদীসে না থাকে, আবার সে ব্যাপারে তিন স্তরের ইজমার কোনটাই সংগঠিত না হয় তাহলে সে ব্যাপারে ইমামের মাযহাবের অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন,

فإن تنازعتم في شيئ فردوه الي الله ورسوله

এখানে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দেয় তাহলে বিষয়টা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে দিকে সমর্পণ করো।’ আপনারাই বলুন, মতভিন্নতা দেখা দেয় কোন বিষয়ে? যে বিষয়ে ইজমা ও উম্মতের ঐকমত্য সংগঠিত হয়েছে সে বিষয়ে কি আর মতভিন্নতা থাকা সম্ভব? ইমাম ফখরুদ্দীন রাজি বলেন, আল্লাহ তা‘আলার এ কথার উদ্দেশ্য হচ্ছে- যে বিষয়ের সমাধান কুরআন-হাদীস ও উম্মতের ইজমা থেকে পাওয়া যাবে না সেই বিষয়ে ইমামগণের মাযহাব অনুসরণ করতে হবে এবং সবগুলোই আল্লাহ ও রাসূলের মর্জি মোতাবেক ইসলামী সমাধান হিসেবে গণ্য হবে।

আলোচনার সারকথা

সূরা মায়েদার তিন নম্বর আয়াতে দীন বলতে ইসলামের বিধিবিধান বোঝানো হয়েছে। ইসলামের এই বিধিবিধান চারটি উৎসের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হবে। সেই চারটি উৎস হলো-

১. কুরআন

২. হাদীস

৩. উম্মতের ইজমা

৪. ইমামগণের মাযহাব

সুতরাং এই চার ঠিকানা ছাড়া অন্য কোন ঠিকানা গ্রহণ করলে সেটা হবে বিদআত।

সুতরাং ইসলামের নামে যদি এমন কিছু করা হয় যেটা এই চার উৎসের কোথাও নেই তাহলে সেটাই হবে বিদআত ।

বিদআতের দৃষ্টান্ত: ঈদে মিলাদুন্নবী

বর্তমানে ১২ই রবিউল আউয়ালে কিছু লোক একটা মিছিল করে। এই মিছিলের নাম জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী। বাংলার মুসলমানগণ! স্মরণ রাখবেন, ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের এক ভন্ডপীরকে বাংলাদেশের চট্রগ্রামে আমন্ত্রন করে আনা হয়েছিলো। সে ভন্ড পীরের নাম তৈয়ব শাহ। সে সর্ব প্রথম বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে ১২ই রবিউল আউয়ালে সমস্ত লোকদের মিছিল করার নির্দেশ দিয়েছিলো। এবং নাম দিয়েছিল জসনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী। ১৯৭৪ সালের আগে এই নামে কেউ মিছিল করেনি। এখন যারা এই নামে মিছিল ও ঈদ পালন করে তাদের বাপ, দাদা, পরদাদা এই নামে ১৯৭৪ সালের আগে কোন মিছিল ও ঈদ পালন করেনি। এই মিছিল না করলে যদি কাফের হয়ে যায়, তাহলে তো তারা সবাই কাফের ছিলো।

তারা এই মিছিলে আরো একটি চটকদার শ্লোগান দিয়ে থাকে- ‘যিন্দা নবীর আগমন শুভেচ্ছার স্বাগতম।’

রাসূল এর ইন্তিকালের পর এমন কিছু লোকের আবির্ভাব হয়েছে যারা রাসূলের ইন্তেকাল মানে না। তারা দাবি করে যে যিন্দা নবীর আবার মরণ কিসের? কেউ বলে যারা নবীর মৃত্যুর বিষয়ে স্বীকৃতি দিবে তারা ওহাবি ও কাফের। নবীজির মৃত্যুর কথা বললেই যদি কাফের হয়ে যায় তাহলে তো আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন,

إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ

আমাদের নবীজীকে আল্লাহ তাআলা সম্বধোন করে বলেন, ‘নিশ্চই আপনি মরণশীল আর তারাও মরণশীল।’ তো নবীজিকে মৃত বললেই যদি কাফের হয়ে যায় তাহলে আল্লাহ তাআলাকে কী বলবে, ফাতাওয়াবাজ!

সুতরাং যারা ফাতাওয়াবাজী করতে করতে লাগামহীন ঘোড়ার মতো হয়ে গিয়েছে তারা এমনভাবেই বলে।

তবে ইসলামের আকীদা সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি বিশুদ্ধ আকীদা হলো, নবী রাসূলদের মৃত্যুর দাফন করা মাত্রই আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জীবিত করে দেন। জীবিত হয়ে নবীগণ আপন আপন রওজা শরীফের ভিতরেই থাকেন। সুতরাং আল্লাহ তাআলা যে কুরআনে বললেন, নবীগণ মরণশীল। এটা দাফনের আগে পাওয়া যায়। আর হাদীসে যে উল্লেখ আছে নবীগণ যিন্দা, এটা দাফনের পর পাওয়া যায়।

তাদের এই শ্লোগানের উদ্দেশ্য যদি এটা হয় যে, রাসূল ইন্তিকালের আগেও যিন্দা পরেও যিন্দা। তাহলে এটা পুরাটাই কুফুরি কথা হবে।

কুরআনে সূরা যুমারে আল্লাহ বলে দিয়েছেন,

إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ

‘নিশ্চয় আপনি মরণশীল।’

সুতরাং তাদের কথা `নবী দাফনের আগেও যিন্দা পরেও যিন্দা’ কুরআন বিরোধী এবং কুফুরি কথা।

আর যদি বলে, প্রথমে রাসূলের ইন্তিকাল হয়েছে, পরে আবার তাঁকে যিন্দা করা হয়েছে এবং সেখান থেকে আমাদের মজলিস সমূহে তিনি আগমন করেন। তাহলে আমরা বলবো যিন্দা হওয়ার কথা তো ঠিক আছে কিন্তু আগমনের কথা কোথায় পেলে? সুতরাং আগমনের বিষয়টা স্পষ্ট গোমরাহী এবং ভন্ডামী।

আপনারা শুরুতেই জেনেছেন, ইসলামের নামে ভ্রান্তি দুই প্রকার।

প্রথম প্রকার ভ্রান্তির মাধ্যমে কাফের হয়ে যায়।

দ্বিতীয় প্রকার ভ্রান্তির মাধ্যমে বেদআতী হয়ে যায়। ভেজালযুক্ত হয়ে যায়।

এ মূলনীতির আলোকে ‘রাসূলের কখনো ইন্তিকাল হয়নি, দাফনের আগেও না পরেও না ’- এটা কুফুরী কথা। আর ‘রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মজলিসে আগমন করেন’ –এটা রাসূল বিরোধী শ্লোগান, হাদীস বিরোধী শ্লোগান। এমন শ্লোগান দিয়ে কেউ আশেকে রাসূল হতে পারে না।

ঈদে মিলাদুন্নবীর ব্যাপারে শরঈ দৃষ্টিভঙ্গি

হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার মুসলমান উম্মতের জন্য বার্ষিক ২টি ঈদের ব্যবস্থা করেছেন। একটি ঈদুল ফিতর, আরেকটি ঈদুল আজহা।

সুতরাং এখন যদি তুমি ১২ই রবিউল আউয়ালে আরেকটি ঈদ পালন করো তাহলে এর সিরিয়াল নম্বর হবে তিন। এ নম্বরটাই তো বলে দিচ্ছে যে, এই ঈদ বিদআত। কারণ রাসূল বলেছেন ২টি। আর তুমি পালন করো ৩টি। ঈদে মীলাদুন্নবীর শুরু শেষ সবটুকুই বিদআত।

আমার আলোচনা থেকে যদি আপনারা পরিপূর্ণ দীনের সংজ্ঞা বুঝে থাকেন তাহলে বলুন তো জশনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী কোথায় আছে?

কুরআনে? হাদীসে? উম্মতের ইজমায়? ইমামগণের মাযহাবে? কোথাও নেই। আছে একজনের মাযহাবে। পাকিস্তানের তৈয়ব শাহ। ১৯৭৪ সালে সে চৌদ্দগ্রাম থেকে ঘোষণা দিয়েছিলো মুসলমান ও আশেকে রাসূল হতে হলে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করতে হবে। আরে, আশেকে রাসূল হতে হলে যদি ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করতে হয় তাহলে তো ১৯৭৪ সালের আগে তোমাদের চৌদ্দপুরুষের কেউই আশেকে রাসূল ছিলেন না। আমরা অনেক আগে থেকেই আশেকে রাসূল ছিলাম, এখনো আছি।

বোঝা গেলো, ঈদে মিলাদুন্নবী ও জশনে জুলুস সম্পূর্ণভাবে বিদআত। কেউ যদি বলে ঈদে ‍মিলাদুন্নবীর ব্যাপারে কুরআনের আয়াত আছে । তাহলে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা দরকার, সেই আয়াত কি তোমার উপর নাযিল হয়েছিলো? রাসূল বুঝলেন না কিন্তু তুমি বুঝতে পারলে? রাসূল যদি বুঝতেন তাহলে তো বলতেন ঈদে মীলাদুন্নাবী নামে একটা ঈদ আছে। তোমার একথা থেকে তো মনে হয় যে, কুরআন রাসূল বুঝেন নি, সেজন্যে করেন নি। তুমিই বুঝেছ বলে করছ। এটা তো রাসূলের সাথে সুস্পষ্ট বেয়াদবী।

এজন্যই মুফাসসিরগণ বলেছেন, রাসূলের শানে সবচেয়ে বড় বেয়াদব হলো বেদাআতিরা। একারণে বেদআতিদের মরণকালে ঈমান নিয়ে মারা যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাওবা করার আগ পর্যন্ত যদি মৃত্যু হয় ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ প্রায় অসম্ভব। শতকরা ৯৯ ভাগ বেইমান হয়ে মৃত্যুবরণ করার আশংকা আছে।

শেষকথা

সুতরাং সাবধান উম্মতে মুসলিমা! মনগড়া কোন কাজ করবেন না। করলে বেদআতি হবেন । আর বেদআতি হলে জান্নাতের পথ হারাবেন। এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

إياكم و محدثات الأمور فإن كل بدعة ضلالة و في رواية وكل ضلالة في النار.

‘তোমরা নবউদ্ভাবিত বিষয়াবলী থেকে বেঁচে থাকো। কেননা প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা। অন্য এক রেওয়ায়েতমতে প্রত্যেক ভ্রষ্টতার শেষ পরিণাম জাহান্নাম।’-(আলমু’জামুল কাবীর লিত তাবরানী, হাদীস:৬১৭, সুনানে নাসায়ী, হাদীস: ১৭৮৬)

বর্তমান যামানায় যারা বেদআতি কথা-বার্তা ছড়ায় তাদের থেকে দূরে থাকবেন । এমন ফেৎনার যামানায় যারা বিদআত থেকে দূরে থাকবে এবং চার দলীলে অটল থাকবে- তাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

المتمسك بسنتي عند فساد أمتي فله أجر شهيد

‘যে ব্যাক্তি ফেতনা ফাসাদের সময় আমার সুন্নতের উপর অটল থাকবে, সে শহীদের সাওয়াব পাবে।’ -(আলমু’জামুল আওসাত লিত তাবরানী, হাদীস: ৫৪১৪)

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সবাইকে শরীয়ত বর্ণিত চার ঠিকানা ও উৎস থেকে ইসলামের বিধিবিধান পালন করে দুনিয়া-আখেরাতের জীবনকে সফল করার তাওফীক দান করুন।

سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَ . وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ . وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

চলমান পোষ্ট

মতামত দিন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না. প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলো * দ্বারা চিহ্নিত করা আছে।

সর্বশেষ পোস্ট

শীর্ষ লেখক

সর্বাধিক মন্তব্য

বৈশিষ্ট্যযুক্ত ভিডিও

ক্যাটাগরি